বহুদিন হইতে যে সমস্ত সম্পত্তির আয় অনাথগণের প্রতিপালনের জন্ম ব্যয়িত হইত, যাহার জন্য জমিদারদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ অক্ষয় পুণ্য ভোগ করিতেছিলেন, আজ জমিদারগণের চক্ষের সমক্ষে হৃদয়হীন রাক্ষস দেবী-সিংহ তাঁহাদের পূর্ব্ব পুরুষগণের পুণ্যকীর্ত্তিগুলির বিলোপ-সাধনে অগ্রসর ‘হইলেন! দীন দুঃখীর মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়া আপনার ঐশ্বর্য্য বৃদ্ধির জন্য অগ্রসর হইলেন!
হিন্দু হইয়া দেবসম্পত্তি অপহরণ করিয়া নরকের দ্বার উদঘাটন করিবার ইচ্ছা করিলেন। অর্থশালী জমিদার ও ভূস্বামীদের লাঞ্ছনার একশেষ করিয়া, নিরীহ প্রজা ও কৃষকগণের উপর তদীয় অত্যাচার-স্রোতঃ প্রবাহিত হয়। যাহারা নিদাঘের রৌদ্র, বর্ষার বর্ষণ মাথায় লইয়া, শীতের তুষারপাতের মধ্যেও অতি কষ্টে কিঞ্চিৎ শক্ত সঞ্চয় করে, যাহারা স্বচ্ছন্দ-বনজাত শাক ও কঙ্করমিশ্রিত লবণের সহিত দুই এক গ্রাস অন্ন মুখে দিয়া জীবন অতি- বাহিত করিয়া থাকে, শতছিদ্রযুক্ত পর্ণকুটীর যাহাদের একমাত্র আশ্রয়-স্থল, দেবী সিংহের অত্যাচার হইতে তাহারাও নিষ্কৃতি পাইল না।
এই সকল লোকদিগের প্রতি অত্যাচারে কিরূপ অর্থলাভের সম্ভাবনা, তাহা দেবীসিংহ নিজেই ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি এইরূপ লিখিয়াছিলেন, “ইহা অত্যন্ত বিড়ম্বনার বিষয় যে, বাঙ্গলার অন্যান্য স্থান অপেক্ষা রঙ্গপুর প্রদেশের কৃষকদিগের মধ্যেই ঘোর অন্নকণ্ঠ উপস্থিত হইয়াছে। শস্য কাটার সময় ব্যতীত অন্য কোন সময়ে তাহাদের ঘরে কোনরূপ সম্পত্তি পাওয়া যায় না; কাজেই তাহাদিগকে অন্য সময়ে অতি কষ্টে আহারের উপায় করিতে হয় এবং এই জন্য দুর্ভিক্ষে বহুসংখ্যক লোক কাল-কবলে পতিত হইতেছে।
দুই একটি মৃৎপাত্র ও একখানি পর্ণকুটার মাত্র তাহাদের সম্বল; ইহাদের সহস্রখানি বিক্রয় করিলেও দশটি টাকা পাওয়া যায় কি না সন্দেহ”। কিন্তু সেই মহাপ্রভু এই সকল দরিদ্র পর্ণকুটীর- বাসিগণের প্রাতও নিজ ক্ষমতা প্রকাশ করিতে ত্রুটি করেন নাই। সামার গোপাল মেষপালের ন্যায় কৃষিজীবিগণ দলে দলে শৃঙ্খলবন্ধ হইয়া.. কারাগারে প্রেরিত হইল; তাহার উপর অবিরত বেত্রাঘাতে তাহাদের অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হইতে লাগিল। অধিকাংশ লোক পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। অশ্রুপূর্ণলোচনে সকলে প্রিয় বাসস্থান পরিত্যাগ করিয়া, অরণ্যে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইল।
শ্রী নিখিলনাথ রায় 



















