০৯:২২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
৭০ বছর আগে সর্বোচ্চ আদালত পাকিস্তানের পরিণতি সিল করে দিয়েছিল—তার প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায় পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি-৯১) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ: ট্রাম্পের সৃষ্ট শূন্যতায় কি নেতৃত্বের আসনে উঠবে চীন? যুক্তরাষ্ট্রে বড় কোম্পানিগুলোতে অস্থিরতা ব্যাবিলন একসময় ছিল প্রাচীন বিশ্বের বিস্ময় আজ গল্পটি ভিন্ন প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-২৯১) রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি আগস্ট থেকে কেন কমালো চীন? ক্যাফেইন কমালে কেন স্বপ্ন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে রবার্ট রেডফোর্ড মৃত্যুকে যেমন দেখেছিলেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কের পথে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ

ব্যাবিলন একসময় ছিল প্রাচীন বিশ্বের বিস্ময় আজ গল্পটি ভিন্ন

হিল্লা, ইরাক —

বিকেলের শেষ প্রহরে মধ্য ইরাকের আকাশে সূর্য ভারী হয়ে ঝুলে আছে। তপ্ত আলোয় ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ রঙিন হয়ে ওঠে। ধুলো উড়ে হালকা কুয়াশার মতো ভেসে বেড়ায়, যার গন্ধ মনে হয় সময়ের চেয়েও পুরনো। এই মুহূর্তে শহরটি একই সাথে শূন্য এবং চিরন্তন মনে হয়। নীরবতা ভঙ্গ করে কেবল কয়েকজন ভ্রমণকারীর পায়ের শব্দ, যারা এখানে এসেছে রাজাদের পদচিহ্নে দাঁড়াতে।

একসময় ব্যাবিলন ছিল মেসোপটেমিয়ার রত্ন, যে শহরের নামে পুরো যুগগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে—প্রাচীন, মধ্য, এবং নব ব্যাবিলনীয় যুগ। এখানেই শাসন করতেন নেবুচাদনেজার দ্বিতীয়, এখানে নির্মিত হয়েছিল বিশাল মন্দির ও প্রাসাদ, এবং এখানেই কবি ও ইতিহাসবিদরা কল্পনা করেছিলেন প্রাচীন বিশ্বের সাত আশ্চর্যের একটি—ঝুলন্ত উদ্যান বা হ্যাংগিং গার্ডেন। আজ এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হলেও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, যেখানে মহিমা ও ক্ষয়ের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য টিকে আছে।

ব্যাবিলনের ভেতর হাঁটলে ইতিহাসের স্তরে হাঁটার অনুভূতি

প্রথমেই দর্শনার্থীরা দেখতে পান পুনর্নির্মিত ইশতার গেট। গভীর নীল রঙের এই প্রবেশদ্বার একসময় সোনালি সিংহ ও ড্রাগনের নকশা দিয়ে সাজানো ছিল। এর বাইরে রয়েছে প্রসেশনাল ওয়ে—একটি আচারিক সড়ক যা রাজকীয় উৎসব, যেমন আকিতু নববর্ষ উদযাপনের জন্য ব্যবহৃত হতো। এটি বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো উৎসবগুলোর একটি বলে মনে করা হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০৫ থেকে ৫৬২ সালের মধ্যে নেবুচাদনেজার দ্বিতীয় তার ক্ষমতার ছাপ রেখেছিলেন এখানেই। তিনি বিশাল প্রাসাদ ও মন্দির নির্মাণ করেন, শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেন এবং শিলালিপি রেখে যান যা আজও তার ক্ষমতার কথা বলে। বিশাল এ্তেমেনাঙ্কি জিগুরাত, যা অনেকের মতে বাইবেলের ‘টাওয়ার অফ ব্যাবেল’-এর অনুপ্রেরণা ছিল, একসময় শহরের আকাশসীমা দখল করে রেখেছিল।

আর আছে ঝুলন্ত উদ্যান। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান লেখকরা এটিকে বর্ণনা করেছেন এক সবুজ স্বর্গোদ্যান হিসেবে, যেখানে ধাপে ধাপে সাজানো উদ্যানগুলোকে সেচ দিত ইউফ্রেটিস নদী থেকে পানি তোলা চমৎকার যন্ত্র। কিংবদন্তি অনুসারে, নেবুচাদনেজার তার স্ত্রী অ্যামিটিসের জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন, যিনি তার জন্মভূমির বনাঞ্চলের জন্য ব্যাকুল ছিলেন।

ইরাকি প্রত্নতত্ত্ববিদ আমের আবদুলরাজ্জাক বিশ্বাস করেন, ঝুলন্ত উদ্যান কেবল কল্পনা নয়। তিনি সিএনএন-কে বলেন, “আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান ছিল বাস্তব। এটি মেসোপটেমীয় প্রকৌশলী ও শিল্পীর সৌন্দর্য, সৃজনশীলতা এবং মহিমার প্রতীক। এটি ছিল ব্যাবিলনের রাজা ও তার শাসনের মহত্ত্বের প্রতিফলন।”

তার মতে, উদ্যানটি বর্তমান ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার অংশ ছিল, যা হিল্লা শহরের কাছাকাছি, বাগদাদ থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ।

কিছু গবেষক মনে করেন উদ্যানটি উত্তর দিকে কয়েকশ মাইল দূরের নিনেভেহ শহরে ছিল। তবে ব্যাবিলনে আসা ভ্রমণকারীদের কাছে বিতর্কের তেমন গুরুত্ব নেই। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়েই তারা কল্পনা করতে পারেন ধাপে ধাপে সাজানো বাগান, ঝর্ণাধারা, আর জীবনের কোলাহলে ভরা এক সজীব শহর।

দর্শনার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে

দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত ও অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও ব্যাবিলন এখনও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে চলেছে। যদিও দর্শনার্থীর সংখ্যা কয়েক দশক আগের তুলনায় অনেক কম, তবুও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ব্যাবিলনের প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এখানে ৪৯,৬২৯ জন দর্শনার্থী এসেছিলেন, যার মধ্যে বিদেশি ছিলেন ৫,৩৭০ জন।

সম্প্রতি এক গরম বিকেলে এখানে ঘুরতে এসেছিলেন তিনজন পর্যটক। তাদের একজন ছিলেন ইতালির মিলান শহরের ৩৫ বছর বয়সী জিয়ানমারিয়া ভারগানি। শৈশব থেকেই ঝুলন্ত উদ্যান তার কল্পনাকে নাড়া দিয়েছিল। তিনি বলেন, “আমি সারা জীবন অপেক্ষা করেছি এখানে দাঁড়ানোর জন্য।”

ভারগানি কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মানচিত্র ও ইতিহাস বই ঘেঁটে তিনি বাগদাদে আসেন। পথে তিনি তায়ক কাসরা নামক দুই হাজার বছরের পুরনো সেতিফনের মহাধ্বংসাবশেষও ঘুরে দেখেন। তারপর ব্যাবিলনের দিকে রওনা হন নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য।

তিনি বলেন, “ভ্রমণের শুরুতেই যখন ইশতার গেট দেখলাম, তখন অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবা কঠিন যে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ এই একই পথে হাঁটত। সাইটে পৌঁছে মনে হলো আমার স্বপ্ন সত্যি হলো।”

অবহেলার চিহ্ন সর্বত্র

তবে ব্যাবিলনের বর্তমান অবস্থা দুঃখজনক। ধ্বংসাবশেষে পৌঁছানোর মূল সড়ক তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও সংযোগ সড়কগুলো ভাঙা এবং কাদাময়। ভেতরে প্রবেশ করলে পথঘাটে আগাছা, ভাঙা পাথরের ফাঁকে গাছপালা গজিয়েছে, আর চারদিকে ছড়িয়ে আছে আবর্জনা। রাজাদের প্রাসাদের আঙিনায় পড়ে থাকে সিগারেটের টুকরো ও প্লাস্টিকের বোতল।

সুবিধা খুবই সীমিত। টিকিট বুথের পর কয়েকটি শৌচাগার থাকলেও আশেপাশে কোনো হোটেল নেই। ফলে ভ্রমণ শেষে পর্যটকদের দূরে ফিরে যেতে হয়। গাইড ছাড়া পথ খুঁজে পাওয়াও কঠিন, কারণ দিকনির্দেশক চিহ্নও খুব কম।

স্থানীয় গাইডরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন দর্শনার্থীদের হতাশা দূর করতে। তবে যারা একা ঘুরতে যান তাদের কাছে অবহেলার চিহ্ন স্পষ্ট। শহরটি জরুরি ভিত্তিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও যত্নের প্রয়োজন।

ব্যাবিলনের প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহ্য অধিদপ্তরের প্রধান রাঈদ হামেদ আবদুল্লাহ বলেন, “পুরো প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় মাত্র চারজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছে। অনেক সময় আমাকে পাহারাদারদেরও পরিষ্কারের কাজে লাগাতে হয়। আমরা ভালোবাসা থেকে চেষ্টা করি, কিন্তু সরকারের পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।”

এখনও পর্যন্ত সমন্বিত উন্নয়ন কাজ শুরু হয়নি। কিছু আংশিক রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চললেও বড় পরিসরের উন্নয়ন নানা আইনি ও রাজনৈতিক জটিলতায় আটকে আছে।

আধুনিক যুগের ক্ষত

ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ শুধু সময়ের কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি। আধুনিক শাসক ও সেনাবাহিনীও এখানে দাগ রেখে গেছে।

১৯৮০-এর দশকে সাদ্দাম হোসেন নিজেকে নেবুচাদনেজারের উত্তরসূরি মনে করে ব্যাবিলন পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। নতুন ইট দিয়ে দেয়াল পুনর্নির্মাণ করা হয়, যার প্রতিটি ইটে খোদাই করা হয় সাদ্দামের নাম। বিশাল এক প্রাসাদ তৈরি হয় ধ্বংসাবশেষের পাশেই, যা সংরক্ষণের বদলে ক্ষমতার প্রদর্শনী ছিল।

দূর থেকে দেখলে দেয়ালে খোদাই করা আরবি লিপি ধর্মীয় শ্লোক মনে হলেও আসলে সেগুলো ছিল সাদ্দামের নামের আদ্যক্ষর। পুরো প্রকল্পটি ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক প্রচার।

২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর ব্যাবিলনে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি স্থাপন করে। সাদ্দামের প্রাসাদকে তারা সদর দপ্তর বানায়। হেলিকপ্টার অবতরণ করে সরাসরি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে। ট্যাঙ্কের চাপে ভঙ্গুর মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৈন্যরা প্রাসাদের ভেতরে দেয়ালে আঁকিবুকি করে। একসময় ক্ষমতার প্রতীক ব্যাবিলন আধুনিক যুদ্ধের শিকার হয়ে পড়ে।

বিশ্ব ঐতিহ্য হলেও পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই

২০১৯ সালের জুলাইয়ে ইউনেস্কো ব্যাবিলনকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এটি ছিল ইরাকের জন্য এক বড় বিজয়। তবে স্বীকৃতি পেলেও সংরক্ষণের অর্থ বরাদ্দ খুব সীমিত। উন্নয়ন পরিকল্পনা থেমে আছে, এবং স্থানীয় গাইডদের প্রচেষ্টার ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু।

আমের আবদুলরাজ্জাক বলেন, “ব্যাবিলন ইরাক এবং বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। এখানে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে বিশেষ তহবিল বরাদ্দ প্রয়োজন।”

ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যাবিলন বাঁচানোর চেষ্টা

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ড ইউএস দূতাবাসের সহায়তায় নিনমাখ মন্দির সংরক্ষণের কাজ করছে।

তবুও সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে স্থানীয় মানুষ। তাদের একজন ২২ বছর বয়সী পর্যটন গাইড হুসেইন হাশেম। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্যাবিলনেই।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভ্রমণের সময় থেকেই তার ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জন্মে। পরবর্তীতে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি পর্যটন খাতে কাজ শুরু করেন।

হাশেম বলেন, “আমার কাজের মাধ্যমে আমি ইতিবাচক বার্তা দিতে চাই। ইরাক নিরাপদ এবং সুন্দর, যেমনটা টিভি বা সামাজিক মাধ্যমে দেখানো হয় না। আমি চাই সবাই আমার দেশ ঘুরে দেখুক।”

দর্শনার্থীরা প্রায়ই তার কাছে ঝুলন্ত উদ্যান সম্পর্কে জানতে চান। হাশেম জানান, জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা একসময় ধারণা করেছিলেন যে, তারা উদ্যানের চিহ্ন পেয়েছেন। কিন্তু পরে ইরাকি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেন যে জায়গাটি আসলে খাদ্য সংরক্ষণের স্থান ছিল। কিছু গবেষক মনে করেন, ইউফ্রেটিস নদীর কাছে উদ্যানের সম্ভাব্য অবস্থান ছিল।

তবে তিনি উদ্বিগ্ন বিনিয়োগের অভাবে। তার মতে, সরকারি সহায়তা ও জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। তিনি দর্শনার্থীদেরও অনুরোধ করেন আবর্জনা না ফেলা এবং প্রাচীন পাথরে নাম খোদাই না করার জন্য।

ইতিহাসের দ্বৈত চিত্র

ব্যাবিলনে হাঁটলে অতীত ও বর্তমানের বিরোধ স্পষ্ট হয়। দক্ষিণ প্রাসাদে একই সাথে নেবুচাদনেজারের খোদাই এবং সাদ্দামের খোদাই দেখা যায়। বিখ্যাত ব্যাবিলনীয় সিংহ এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তবে চারপাশে আগাছা। আসল ইশতার গেট জার্মানির বার্লিনের পার্গামন মিউজিয়ামে সংরক্ষিত, ব্যাবিলনে আছে কেবল একটি আংশিক পুনর্নির্মাণ।

প্রত্নতাত্ত্বিক সীমানার বাইরে আছে ফলের বাগান, পিকনিক স্পট, আবাসিক এলাকা এবং একটি পুলিশ স্টেশন।

সবকিছু সত্ত্বেও ব্যাবিলন এখনও মুগ্ধতা জাগায়। দর্শনার্থীরা আজও ইশতার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়। ঝুলন্ত উদ্যান নিয়ে বিতর্ক এখনও চলে। গবেষকরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, আর ভ্রমণকারীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যান।

ইতালীয় পর্যটক ভারগানি বলেন, “ইরাকের সৌন্দর্য ও ইতিহাসের বাইরে আমি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি এখানকার মানুষের জন্য—সহৃদয়, সহায়ক, হাসিখুশি, অসাধারণ।”

৭০ বছর আগে সর্বোচ্চ আদালত পাকিস্তানের পরিণতি সিল করে দিয়েছিল—তার প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায়

ব্যাবিলন একসময় ছিল প্রাচীন বিশ্বের বিস্ময় আজ গল্পটি ভিন্ন

০৪:০০:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হিল্লা, ইরাক —

বিকেলের শেষ প্রহরে মধ্য ইরাকের আকাশে সূর্য ভারী হয়ে ঝুলে আছে। তপ্ত আলোয় ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ রঙিন হয়ে ওঠে। ধুলো উড়ে হালকা কুয়াশার মতো ভেসে বেড়ায়, যার গন্ধ মনে হয় সময়ের চেয়েও পুরনো। এই মুহূর্তে শহরটি একই সাথে শূন্য এবং চিরন্তন মনে হয়। নীরবতা ভঙ্গ করে কেবল কয়েকজন ভ্রমণকারীর পায়ের শব্দ, যারা এখানে এসেছে রাজাদের পদচিহ্নে দাঁড়াতে।

একসময় ব্যাবিলন ছিল মেসোপটেমিয়ার রত্ন, যে শহরের নামে পুরো যুগগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে—প্রাচীন, মধ্য, এবং নব ব্যাবিলনীয় যুগ। এখানেই শাসন করতেন নেবুচাদনেজার দ্বিতীয়, এখানে নির্মিত হয়েছিল বিশাল মন্দির ও প্রাসাদ, এবং এখানেই কবি ও ইতিহাসবিদরা কল্পনা করেছিলেন প্রাচীন বিশ্বের সাত আশ্চর্যের একটি—ঝুলন্ত উদ্যান বা হ্যাংগিং গার্ডেন। আজ এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হলেও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, যেখানে মহিমা ও ক্ষয়ের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য টিকে আছে।

ব্যাবিলনের ভেতর হাঁটলে ইতিহাসের স্তরে হাঁটার অনুভূতি

প্রথমেই দর্শনার্থীরা দেখতে পান পুনর্নির্মিত ইশতার গেট। গভীর নীল রঙের এই প্রবেশদ্বার একসময় সোনালি সিংহ ও ড্রাগনের নকশা দিয়ে সাজানো ছিল। এর বাইরে রয়েছে প্রসেশনাল ওয়ে—একটি আচারিক সড়ক যা রাজকীয় উৎসব, যেমন আকিতু নববর্ষ উদযাপনের জন্য ব্যবহৃত হতো। এটি বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো উৎসবগুলোর একটি বলে মনে করা হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০৫ থেকে ৫৬২ সালের মধ্যে নেবুচাদনেজার দ্বিতীয় তার ক্ষমতার ছাপ রেখেছিলেন এখানেই। তিনি বিশাল প্রাসাদ ও মন্দির নির্মাণ করেন, শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেন এবং শিলালিপি রেখে যান যা আজও তার ক্ষমতার কথা বলে। বিশাল এ্তেমেনাঙ্কি জিগুরাত, যা অনেকের মতে বাইবেলের ‘টাওয়ার অফ ব্যাবেল’-এর অনুপ্রেরণা ছিল, একসময় শহরের আকাশসীমা দখল করে রেখেছিল।

আর আছে ঝুলন্ত উদ্যান। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান লেখকরা এটিকে বর্ণনা করেছেন এক সবুজ স্বর্গোদ্যান হিসেবে, যেখানে ধাপে ধাপে সাজানো উদ্যানগুলোকে সেচ দিত ইউফ্রেটিস নদী থেকে পানি তোলা চমৎকার যন্ত্র। কিংবদন্তি অনুসারে, নেবুচাদনেজার তার স্ত্রী অ্যামিটিসের জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন, যিনি তার জন্মভূমির বনাঞ্চলের জন্য ব্যাকুল ছিলেন।

ইরাকি প্রত্নতত্ত্ববিদ আমের আবদুলরাজ্জাক বিশ্বাস করেন, ঝুলন্ত উদ্যান কেবল কল্পনা নয়। তিনি সিএনএন-কে বলেন, “আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান ছিল বাস্তব। এটি মেসোপটেমীয় প্রকৌশলী ও শিল্পীর সৌন্দর্য, সৃজনশীলতা এবং মহিমার প্রতীক। এটি ছিল ব্যাবিলনের রাজা ও তার শাসনের মহত্ত্বের প্রতিফলন।”

তার মতে, উদ্যানটি বর্তমান ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার অংশ ছিল, যা হিল্লা শহরের কাছাকাছি, বাগদাদ থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ।

কিছু গবেষক মনে করেন উদ্যানটি উত্তর দিকে কয়েকশ মাইল দূরের নিনেভেহ শহরে ছিল। তবে ব্যাবিলনে আসা ভ্রমণকারীদের কাছে বিতর্কের তেমন গুরুত্ব নেই। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়েই তারা কল্পনা করতে পারেন ধাপে ধাপে সাজানো বাগান, ঝর্ণাধারা, আর জীবনের কোলাহলে ভরা এক সজীব শহর।

দর্শনার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে

দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত ও অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও ব্যাবিলন এখনও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে চলেছে। যদিও দর্শনার্থীর সংখ্যা কয়েক দশক আগের তুলনায় অনেক কম, তবুও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ব্যাবিলনের প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এখানে ৪৯,৬২৯ জন দর্শনার্থী এসেছিলেন, যার মধ্যে বিদেশি ছিলেন ৫,৩৭০ জন।

সম্প্রতি এক গরম বিকেলে এখানে ঘুরতে এসেছিলেন তিনজন পর্যটক। তাদের একজন ছিলেন ইতালির মিলান শহরের ৩৫ বছর বয়সী জিয়ানমারিয়া ভারগানি। শৈশব থেকেই ঝুলন্ত উদ্যান তার কল্পনাকে নাড়া দিয়েছিল। তিনি বলেন, “আমি সারা জীবন অপেক্ষা করেছি এখানে দাঁড়ানোর জন্য।”

ভারগানি কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মানচিত্র ও ইতিহাস বই ঘেঁটে তিনি বাগদাদে আসেন। পথে তিনি তায়ক কাসরা নামক দুই হাজার বছরের পুরনো সেতিফনের মহাধ্বংসাবশেষও ঘুরে দেখেন। তারপর ব্যাবিলনের দিকে রওনা হন নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য।

তিনি বলেন, “ভ্রমণের শুরুতেই যখন ইশতার গেট দেখলাম, তখন অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবা কঠিন যে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ এই একই পথে হাঁটত। সাইটে পৌঁছে মনে হলো আমার স্বপ্ন সত্যি হলো।”

অবহেলার চিহ্ন সর্বত্র

তবে ব্যাবিলনের বর্তমান অবস্থা দুঃখজনক। ধ্বংসাবশেষে পৌঁছানোর মূল সড়ক তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও সংযোগ সড়কগুলো ভাঙা এবং কাদাময়। ভেতরে প্রবেশ করলে পথঘাটে আগাছা, ভাঙা পাথরের ফাঁকে গাছপালা গজিয়েছে, আর চারদিকে ছড়িয়ে আছে আবর্জনা। রাজাদের প্রাসাদের আঙিনায় পড়ে থাকে সিগারেটের টুকরো ও প্লাস্টিকের বোতল।

সুবিধা খুবই সীমিত। টিকিট বুথের পর কয়েকটি শৌচাগার থাকলেও আশেপাশে কোনো হোটেল নেই। ফলে ভ্রমণ শেষে পর্যটকদের দূরে ফিরে যেতে হয়। গাইড ছাড়া পথ খুঁজে পাওয়াও কঠিন, কারণ দিকনির্দেশক চিহ্নও খুব কম।

স্থানীয় গাইডরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন দর্শনার্থীদের হতাশা দূর করতে। তবে যারা একা ঘুরতে যান তাদের কাছে অবহেলার চিহ্ন স্পষ্ট। শহরটি জরুরি ভিত্তিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও যত্নের প্রয়োজন।

ব্যাবিলনের প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহ্য অধিদপ্তরের প্রধান রাঈদ হামেদ আবদুল্লাহ বলেন, “পুরো প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় মাত্র চারজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছে। অনেক সময় আমাকে পাহারাদারদেরও পরিষ্কারের কাজে লাগাতে হয়। আমরা ভালোবাসা থেকে চেষ্টা করি, কিন্তু সরকারের পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।”

এখনও পর্যন্ত সমন্বিত উন্নয়ন কাজ শুরু হয়নি। কিছু আংশিক রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চললেও বড় পরিসরের উন্নয়ন নানা আইনি ও রাজনৈতিক জটিলতায় আটকে আছে।

আধুনিক যুগের ক্ষত

ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ শুধু সময়ের কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি। আধুনিক শাসক ও সেনাবাহিনীও এখানে দাগ রেখে গেছে।

১৯৮০-এর দশকে সাদ্দাম হোসেন নিজেকে নেবুচাদনেজারের উত্তরসূরি মনে করে ব্যাবিলন পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। নতুন ইট দিয়ে দেয়াল পুনর্নির্মাণ করা হয়, যার প্রতিটি ইটে খোদাই করা হয় সাদ্দামের নাম। বিশাল এক প্রাসাদ তৈরি হয় ধ্বংসাবশেষের পাশেই, যা সংরক্ষণের বদলে ক্ষমতার প্রদর্শনী ছিল।

দূর থেকে দেখলে দেয়ালে খোদাই করা আরবি লিপি ধর্মীয় শ্লোক মনে হলেও আসলে সেগুলো ছিল সাদ্দামের নামের আদ্যক্ষর। পুরো প্রকল্পটি ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক প্রচার।

২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর ব্যাবিলনে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি স্থাপন করে। সাদ্দামের প্রাসাদকে তারা সদর দপ্তর বানায়। হেলিকপ্টার অবতরণ করে সরাসরি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে। ট্যাঙ্কের চাপে ভঙ্গুর মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৈন্যরা প্রাসাদের ভেতরে দেয়ালে আঁকিবুকি করে। একসময় ক্ষমতার প্রতীক ব্যাবিলন আধুনিক যুদ্ধের শিকার হয়ে পড়ে।

বিশ্ব ঐতিহ্য হলেও পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই

২০১৯ সালের জুলাইয়ে ইউনেস্কো ব্যাবিলনকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এটি ছিল ইরাকের জন্য এক বড় বিজয়। তবে স্বীকৃতি পেলেও সংরক্ষণের অর্থ বরাদ্দ খুব সীমিত। উন্নয়ন পরিকল্পনা থেমে আছে, এবং স্থানীয় গাইডদের প্রচেষ্টার ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু।

আমের আবদুলরাজ্জাক বলেন, “ব্যাবিলন ইরাক এবং বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। এখানে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে বিশেষ তহবিল বরাদ্দ প্রয়োজন।”

ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যাবিলন বাঁচানোর চেষ্টা

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ড ইউএস দূতাবাসের সহায়তায় নিনমাখ মন্দির সংরক্ষণের কাজ করছে।

তবুও সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে স্থানীয় মানুষ। তাদের একজন ২২ বছর বয়সী পর্যটন গাইড হুসেইন হাশেম। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্যাবিলনেই।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভ্রমণের সময় থেকেই তার ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জন্মে। পরবর্তীতে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি পর্যটন খাতে কাজ শুরু করেন।

হাশেম বলেন, “আমার কাজের মাধ্যমে আমি ইতিবাচক বার্তা দিতে চাই। ইরাক নিরাপদ এবং সুন্দর, যেমনটা টিভি বা সামাজিক মাধ্যমে দেখানো হয় না। আমি চাই সবাই আমার দেশ ঘুরে দেখুক।”

দর্শনার্থীরা প্রায়ই তার কাছে ঝুলন্ত উদ্যান সম্পর্কে জানতে চান। হাশেম জানান, জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা একসময় ধারণা করেছিলেন যে, তারা উদ্যানের চিহ্ন পেয়েছেন। কিন্তু পরে ইরাকি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেন যে জায়গাটি আসলে খাদ্য সংরক্ষণের স্থান ছিল। কিছু গবেষক মনে করেন, ইউফ্রেটিস নদীর কাছে উদ্যানের সম্ভাব্য অবস্থান ছিল।

তবে তিনি উদ্বিগ্ন বিনিয়োগের অভাবে। তার মতে, সরকারি সহায়তা ও জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। তিনি দর্শনার্থীদেরও অনুরোধ করেন আবর্জনা না ফেলা এবং প্রাচীন পাথরে নাম খোদাই না করার জন্য।

ইতিহাসের দ্বৈত চিত্র

ব্যাবিলনে হাঁটলে অতীত ও বর্তমানের বিরোধ স্পষ্ট হয়। দক্ষিণ প্রাসাদে একই সাথে নেবুচাদনেজারের খোদাই এবং সাদ্দামের খোদাই দেখা যায়। বিখ্যাত ব্যাবিলনীয় সিংহ এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তবে চারপাশে আগাছা। আসল ইশতার গেট জার্মানির বার্লিনের পার্গামন মিউজিয়ামে সংরক্ষিত, ব্যাবিলনে আছে কেবল একটি আংশিক পুনর্নির্মাণ।

প্রত্নতাত্ত্বিক সীমানার বাইরে আছে ফলের বাগান, পিকনিক স্পট, আবাসিক এলাকা এবং একটি পুলিশ স্টেশন।

সবকিছু সত্ত্বেও ব্যাবিলন এখনও মুগ্ধতা জাগায়। দর্শনার্থীরা আজও ইশতার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়। ঝুলন্ত উদ্যান নিয়ে বিতর্ক এখনও চলে। গবেষকরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, আর ভ্রমণকারীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যান।

ইতালীয় পর্যটক ভারগানি বলেন, “ইরাকের সৌন্দর্য ও ইতিহাসের বাইরে আমি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি এখানকার মানুষের জন্য—সহৃদয়, সহায়ক, হাসিখুশি, অসাধারণ।”