হাসপাতালের ভয়াবহ অবস্থা
গাজার আল-শিফা হাসপাতাল বর্তমানে নগরীর অল্প কিছু কার্যকর হাসপাতালের একটি। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিদিনই এখানে গণহারে আহতদের আসা অব্যাহত, অথচ চিকিৎসার সরঞ্জাম প্রায় নেই। অধিকাংশ অস্ত্রোপচার চলছে অপরিষ্কার পরিবেশে, অ্যানেস্থেসিয়া ও ব্যথানাশক ওষুধের অভাবে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক নাদা আবু আলরুব জানান, প্রতিদিনই যেন গণহত্যার দৃশ্য চোখের সামনে ঘটে। তিনি বলেন, গুরুতর আহতদের প্রায় বিনা অ্যানেস্থেসিয়াতেই অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। অনেকের শরীরের অঙ্গ ঝুলে আছে চামড়া আর টেন্ডনে, মস্তিষ্ক ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বেরিয়ে আসছে।
ভয়াবহ মানবিক গল্প
গত সপ্তাহে নয় মাসের এক গর্ভবতী নারীর মাথা উড়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা জরুরি সিজারিয়ান করেন। অলৌকিকভাবে নবজাতক কন্যাশিশুকে বাঁচানো সম্ভব হয়। শিশুটি দুর্বল ছিল, তবে অন্য একটি হাসপাতালে স্থানান্তরের পর চিকিৎসা চলছে।
অস্ট্রেলীয় অ্যানেস্থেসিস্ট সায়া আজিজ বলেন, হাসপাতালে মাত্র একজন অর্থোপেডিক সার্জন থাকায় অনেক জরুরি রোগী অপেক্ষায় রয়েছেন। এক ছয় বছরের ছেলে তিন দিন ধরে ভাঙা হাত-পায়ের অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় ছিল। এদিকে প্রতি কয়েক ঘণ্টা পরপরই একাধিক অঙ্গচ্ছেদ কেস আসছে।
তিনি আরও জানান, অস্ত্রোপচারের কক্ষে মাছি তাড়াতে হচ্ছে, রক্ত ছড়িয়ে আছে, কোনো যন্ত্রপাতি নেই, নেই বিকল্প সরঞ্জাম। চিকিৎসকদের অসহায় দুঃখ চোখে পড়ছে।
ইসরায়েলি বাহিনীর অগ্রযাত্রা
ইসরায়েলি সেনারা হাসপাতালের মাত্র ৫০০ মিটার দূরে পৌঁছেছে। দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ট্যাংক শহরের কেন্দ্রে প্রবেশ করছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা গেছে, ট্যাংক রিমাল পাড়ায় হামিদ মোড়ে অবস্থান নিয়েছে—যেটি আল-শিফার খুব কাছেই।
ফাতিহ সাবাহ নামে এক ফিলিস্তিনি সাংবাদিক জানান, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে তাঁদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিছু জিনিস আনতে গিয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ ট্যাংক ঘিরে ফেলে। পেছনের দরজা দিয়ে কষ্ট করে তারা প্রাণে বেঁচে আসতে পেরেছেন।
গণউচ্ছেদ ও আশ্রয় সঙ্কট
হামলা শুরুর আগে গাজা নগরীতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস করত। জাতিসংঘ জানিয়েছে, অন্তত ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ দক্ষিণে পালিয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা বলছে, এই সংখ্যা ৬ লাখ ৪০ হাজার।
মানুষকে দক্ষিণের আল-মাওয়াসি এলাকায় যেতে বলা হয়েছে, যেটিকে ‘মানবিক অঞ্চল’ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। তবে যাত্রাপথে উপকূলীয় সড়কগুলো ভিড়াক্রান্ত, পরিবারগুলোকে কয়েক ঘণ্টা ধরে আটকে থাকতে হচ্ছে। পালানোর খরচও প্রতিটি পরিবারের জন্য ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে, যা অধিকাংশের পক্ষে অসম্ভব।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, দক্ষিণে তাবু ক্যাম্পগুলো গাদাগাদি আর অনিরাপদ, হাসপাতালগুলো ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ রোগী সামলাচ্ছে।
হাসপাতাল বন্ধ ও ধ্বংস
প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, আল-কুদস হাসপাতালের অক্সিজেন স্টেশন গোলাগুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে থাকা সিলিন্ডার দিয়ে মাত্র তিন দিন চিকিৎসা চালানো সম্ভব হবে।
অন্যদিকে আল-রান্তিসি শিশু হাসপাতাল ও সেন্ট জন আই হাসপাতাল রোগী সরিয়ে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। জর্ডান তাদের ফিল্ড হাসপাতালও দক্ষিণে সরিয়ে নিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, প্যালেস্টাইন মেডিকেল রিলিফ সোসাইটির প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছে, যেখানে দুইজন স্বাস্থ্যকর্মী আহত হয়েছেন। এই কেন্দ্রটি রক্তদান, জরুরি সেবা, ক্যানসার ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসা দিচ্ছিল।
যুদ্ধের পটভূমি ও হতাহতের সংখ্যা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের দক্ষিণ ইসরায়েলে আক্রমণে প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান চালাচ্ছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত অন্তত ৬৫ হাজার ৩৮০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।