এ পর্যন্ত নিম্নশিক্ষার বিষয় বলিতেছিলাম। পুনরায় উচ্চশিক্ষার কথা বলিতে প্রবৃত্ত হইলাম। গবর্ণর জেনেরল লর্ড মেও বাহাদুর দেশের উচ্চশিক্ষা উঠাইয়া দিতে চাহিলে মহামান্য গ্রে সাহেব তাহার খুব প্রতিবাদ করেন। তাহার প্রতিবাদেই উচ্চশিক্ষা একবারে উঠিয়া গেল না বটে, কিন্তু সেই হইতেই গবর্ণমেন্ট উচ্চশিক্ষাতে বেশি উৎসাহ না দিয়া নিম্নশিক্ষাতে বেশি অর্থ ব্যয় করিতে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু এ ঘটনাতে কলিকাতার নিকটবর্তী উন্নত স্থানেরই বিশেষ অসুবিধা বোধ হইতে লাগিল। দেশীয় রাজা, জমিদার, মহাজন, ধনী, ক্ষমতাশালী প্রভৃতিরা নীরব রহিলেন না। তাহার উচ্চ শিক্ষার স্রোত প্রবাহিত জন্য বেশি অগ্রসর হইলেন। এই ঘটনার কিছুকাল পরেই অর্থাৎ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাজসাহী জেলা স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষীয় শ্রেণি সংযোজিত করিয়া দ্বিতীয় শ্রেণি কলেজে পরিণত করিবার জন্য দুবলহাটির রাজা হরনাথ রায় বাহাদুর তাহার জমিদারি মধ্যে বার্ষিক ৫০০০ টাকা আয়ের সম্পত্তি গবর্ণমেন্টকে দান করেন। লর্ড মেওর পর লর্ড নর্থব্রুক গবর্ণর জেনেরলের পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া উচ্চঅঙ্গের ইংরেজি শিক্ষার উৎসাহ দিতে লাগিলেন। অতএব রাজা হরনাথের মহৎকার্য গবর্ণমেন্ট অনুমোদন করিলেন। ইহার কিছুদিন পরেই “রাজসাহী এসোসিয়েসনের” পক্ষ হইতে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমথনাথ বাহাদুরের সাহায্যে ও উদ্যোগে ঐ কলেজে তৃতীয় ও চতুর্থবর্ষীয় শ্রেণি সংযোজিত করিয়া প্রথম শ্রেণি কলেজে পরিণত হয়। রাজা প্রসন্ননাথ রায় বাহাদুর মফস্বলে উচ্চ শিক্ষা বীজ প্রথমে ছড়ান। কিন্তু তাহার পুত্র রাজা প্রমথনাথ রায় বাহাদুর সেই বীজ হইতে পুষ্ট ও পরিপক্ক ফল শোভিত অত্যুচ্চ বৃক্ষ উৎপাদন করিলেন এবং সেই বৃক্ষের সুস্বাদু ফল জেলার সর্বত্র বিতরণ করিলেন। রাজা প্রসন্ননাথকে অনুকরণ করিয়া রাজসাহীর অন্যান্য রাজা বা প্রধান লোকেরা উচ্চ শিক্ষার বীজ জেলার স্থানে স্থানে ছড়াইতে অগ্রসর হইলেন। এই রাজসাহী কলেজে দুবলহাটির রাজা হরনাথ, দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমথনাথ, পুঠিয়ার রাজা যোগেন্দ্রনাথ রায়, মহারাণী শরৎসুন্দরী এবং তাহার পুত্রবধূ রাণী হেমন্তকুমারী দেবী প্রচুর অর্থদান করেন। এই কলেজের সহিত দুইটি (হোস্টেল) ছাত্র নিবাস সংযোজিত আছে। একটি দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদানাথ রায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং আর একটি পুঁঠিয়ার রাণী হেমন্তকুমারী দেবী প্রতিষ্ঠিত করেন। এই মহৎ কার্য জন্য রাজসাহীবাসীরা উল্লিখিত রাজা ও রাণীদের নিকট ঋণী। ইহারাই ধনের সার্থকতা করিয়া জনসমাজে যশস্বী হইয়াছেন। জেলায় ক্রমান্বয়ে যে যে উচ্চ শ্রেণির স্কুল মফঃস্বলে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহার বিস্তৃত বিবরণ নিম্নে প্রকাশিত হইল:-
১. ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ননাথ ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইবার পাঁচ বৎসর পূর্বে এই দিঘাপতিয়া স্কুল স্থাপিত। এ জেলায় এ একটি লব্ধপ্রতিষ্ঠ উচ্চ শ্রেণির স্কুল। ইহার খ্যাতি অনেকদিন হইতে এবং অনেক দূরে বিস্তৃত। স্কুল গৃহ এবং তৎসঙ্গে যাবতীয় কাগজপত্র অগ্নিভস্মীভূত হওয়াতে প্রথম হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকার ফল জানা কঠিন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ হইতে ৫৪ জন প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে। এই ৮ বৎসর গড়ে প্রতি বৎসর ৭ জন ছাত্র উত্তীর্ণ। এই স্কুল প্রায় প্রতি বৎসর জুনিয়ার বৃত্তি প্রাপ্ত হয়।
২. পুঠিয়ার রাজা পরেশনারায়ণ রায় বাহাদুর ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে পুঠিয়াতে একটি মধ্যশ্রেণি বাংলা স্কুল স্থাপিত করেন। সেই স্কুল ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মধ্য ইংরেজি এবং ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ শ্রেণি ইংরেজি স্কুলে পরিণত হইয়া আছে। এই ঊনবিংশতি বৎসর মধ্যে ৫২ জন ছাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। গড়ে প্রতি বৎসর ৩ জন উত্তীর্ণ।
৩. নাটোরে আদিতে একটি লব্ধ প্রতিষ্ঠ মধ্য শ্রেণি বাংলা স্কুল ছিল। নাটোরের মুসলমান জমিদার রশিদ এ স্কুলকে মধ্যশ্রেণি ইংরেজিতে পরিণত করেন। তদপর নাটোর মিউনিসিপালিটির সাহায্যে ও যত্নে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ঐ স্কুল উচ্চ শ্রেণিতে পরিণত হইয়া আছে। সম্প্রতি এই বিদ্যালয়ের ব্যয়ভার নাটোরের মহারাজা গ্রহণ করিয়াছেন। এটি এক্ষণ নাটোর মহারাজার স্কুল। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ হইতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ছাত্র প্রথম প্রেরিত হয়। এই চতুৰ্দ্দশ বৎসরে ৫১ জন ছাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, তন্মধ্যে ৪৩ জন ছাত্র ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ হইতে ৭ বৎসরে উত্তীর্ণ। পূর্ব সাত বৎসরে ৮ জন এবং শেষ সাত বৎসরে ৪৩ জন উত্তীর্ণ হইয়াছে এবং অনেকে জুনিয়ার বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়াছে। মফস্বল স্কুল মধ্যে এই স্কুল হইতেই মুসলমান ছাত্র বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া আসিতেছে। বর্তমানে স্কুলের অবস্থা উন্নত।
৪. নওগাঁতে মহকুমা স্থাপিত হইবার দুই বৎসর পরে অর্থাৎ ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে গাঁজা অফিসের প্রধান কর্মচারী সবডেপুটি বাবু কৃষ্ণধন বাগচির যত্নে এবং উদ্যোগে একটি উচ্চশ্রেণি ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয়। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের যত্নে একটি ইস্টক নির্মিত গৃহ প্রস্তুতের উদ্যোগ হইতেছে। স্থাপিত হইবার ২/৩ বৎসর পর প্রবেশিকা পরীক্ষায় ছাত্র প্রেরিত হয়। এই ১২/১৩ বৎসরে ২২ জন ছাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।
৫. এক বৎসরের অধিক কাল হইল উকিল ও স্থানীয় ভদ্রলোকদের যত্নে ও উদ্যোগে বোয়ালিয়াতে “বোয়ালিয়া একাডেমী” নামে একটি উচ্চশ্রেণি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই বিদ্যালয়ে খাজুরা নিবাসী জমিদার বাবু জীবন্তি নাথ খাঁ এক হাজার টাকা দান করিয়া পিতা ভোলানাথ খাঁর নাম চিরস্মরণীয় করেন। অতএব এই বিদ্যালয় “ভোলানাথ একাডেমী” বলিয়া প্রসিদ্ধ।
এই সকল উচ্চশ্রেণি ইংরেজি স্কুল ও রাজসাহী কলেজ স্থাপিত হওয়াতে রাজসাহী জেলার উচ্চ শিক্ষা স্রোত অতিবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল। আবার উত্তরবঙ্গ রেলওয়ে প্রতিষ্ঠিত হইবার পর রাজসাহীবাসীদের নিকট কলিকাতা ১০ দিনের পথ হইতে কয়েক ঘণ্টার পথ হইল। ইহাতে উচ্চ শিক্ষার স্রোত আরো দ্বিগুণ বেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল। এই সুযোগে রাজা জমিদারগণের সন্তানেরা রাজসাহীকে উপেক্ষা করিয়া কলিকাতায় আরো উৎকৃষ্ট শিক্ষা পাইবে বলিয়া কলিকাতাভিমুখে যাত্রা করিলেন। ইহার জাজ্বল্য প্রমাণ দিঘাপতিয়া রাজবংশ। রাজসাহীতে বড় রাজাদিগের মধ্যে দিঘাপতিয়া বংশের কুমারগণ যেরূপ সুশিক্ষিত হইয়াছেন এরূপ দৃষ্টান্ত রাজসাহীতে কেন অনেক জেলায় অতি বিরল। এখন রাজসাহীতে বি, এ; এম, এ, বি, এল অনেক। তজ্জন্য আমরা রাজসাহীর গৌরব করি না; কিন্তু রাজ সন্তানেরা যে বি, এ; এম, এ হইতেছেন বা সুশিক্ষিত হইতেছেন, ইহাই রাজসাহীর গৌরব। ইহা হইতে রাজসাহীতে আর একটি গৌরবের স্থল এই যে,- একটি ছাত্র রাজসাহী কলেজ হইতে প্রবেশিকা ও এফ, এ, পরীক্ষা দিয়া কলিকাতায় অধ্যয়ন করে এবং বি,এ; এম,এ, অতি সুখ্যাতির সহিত উত্তীর্ণ হওয়ার পর “রায়চাঁদ প্রেমচাঁদ স্কলার” হইয়াছেন। ইহার নাম যদুনাথ সরকার; ইহার জন্মস্থান রাজসাহী। ইনি একটি সম্ভ্রান্ত জমিদার সন্তান। তিনি আজ কলেজের অধ্যাপক। আডাম সাহেবের সময় যে রাজসাহী অশিক্ষিত লোকের বাসস্থান বলিয়া পরিচিত হয়, অথচ রাজসাহীবাসীরা বুদ্ধিমান বলিয়া পরিচিত ছিল; বিনা যত্নে এবং কালের দুর্বিপাকে সেই রাজসাহীবাসীদের বুদ্ধি লুক্কাইত ছিল। ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের যত্নে ও সুশাসন বলে এবং রাজানুগ্রহে, আজ সেই বুদ্ধি প্রচার পাইতেছে। ইংরেজিতে না হউক, সংস্কৃতে রাজসাহীর এককালে হীন অবস্থা ছিল না। যে কুল্লুকভট্টকে মহাত্মা স্যর উইলিয়াম জোন্স সাহেব ইউরোপ ও এশিয়ার টীকাকারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন দিয়াছেন, তাহার জন্মস্থান রাজসাহী প্রদেশ। সেই দিনের কথা মনে করিলে তখন রাজসাহী প্রদেশের কি উন্নত অবস্থা? তখন রাজসাহী পণ্ডিত সমাজ, তখন রাজসাহী সভ্যতার শিরোমণি, তখন রাজসাহী ধর্মস্থান, তখন রাজসাহী আর্য জাতির গৌরব স্থান। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাধিধারীদের জন্য আমরা গৌরব করিতেছি; ইহারা কুল্লুকভট্টের ন্যায় পণ্ডিতগণের সমকক্ষ হইতে পারেন না। যে আর্য সন্তানের নাম ইউরোপ ও এশিয়ায় বিস্তৃত এবং সম্মানিত, তাহার জন্যই আমরা গৌরব করিতে পারি। সেকাল অনেক দিন গত। ইহা কি কালের বিচিত্র গতি না রাজসাহীর ভাগ্যে দোষ? হিন্দু রাজাদের পর হইতে আমাদের ভাগ্য অপ্রসন্ন হয়। দেশ যবনাক্রান্ত হইতেই আর্য জাতির সভ্যতা, পাণ্ডিত্য, ধর্ম ও জ্ঞান লোপ পাইতে লাগিল। মুসলমান রাজ্যের ধ্বংসের পর হইতে আর্য জাতিরা ধীরে ধীরে সভ্যতা, পাণ্ডিত্য ও ধর্মের পুনরুদ্ধার করিতে সক্ষম হইতেছেন। পুনরুদ্ধারের প্রধান কারণই ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের যত্ন, সুশাসন, দয়া এবং সাহায্য। এ দুর্দিনে কৃপাবান ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট রক্ষা না করিলে আর্য জাতির উপায়ান্তর নাই। ২৭ এই ঊনবিংশতি শতাব্দীতেও সংস্কৃত জন্য রাজসাহী গৌরব করিতেন, তাহারই উন্নতি জন্য দয়াবান গবর্ণমেন্ট বিশেষ সাহায্য করিতেছেন। তথাপি রাজসাহীর ব্রাহ্মাণ পণ্ডিতেরা নিজ নিজ সন্তানকে ইউরোপীয় শিক্ষা দিবার জন্য লালায়িত। পুরকালে রাজা জমিদারগণ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের টোল চতুষ্পাঠীর ব্যয় নির্বাহার্থ ভূমি বা অর্থ যথেষ্ট দান করিতেন। এক্ষণে সে প্রথা প্রায় রহিত। অতএব ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা উপায়ান্তর না দেখিয়া দাসত্বের উপযোগী করিবার জন্য নিজ নিজ সন্তানকে অর্থকরী বিদ্যা শিক্ষা দিতেই অগ্রসর হইতেছেন। ইহাই রাজসাহীর দুর্ভাগ্য।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















