যে বিজ্ঞান শাস্ত্রের ও শিল্প বিদ্যার স্রোত আজ বঙ্গদেশে প্রবাহিত তাহা পুরাকালে ভারতবর্ষীয় আর্যজাতিরা কি পুরুষ কি স্ত্রীলোক সকলকেই শিক্ষা দিতেন। সেকালে সাধারণ বিজ্ঞান ও শিক্ষা হিন্দুদিগের প্রতি গৃহে শিল্প চর্চা হইত। হিন্দুর গৃহে গৃহে যুবতী সূচিকা ও চিত্রকর; বৃদ্ধ মাতা চিকিৎসক ছিলেন। সেকালে যুবতীরা সংসারের আবশ্যকীয় সূচের কার্য নির্বাহ করিতেন এবং পটাদিও চিত্র করিতে পারিতেন। বালক বালিকাদিগের সামান্য ব্যাধিতে সেকালের মাতা এখনকার কালের বঙ্গদেশের মাতার ন্যায় কথায় কথায় দৌড়িয়া ডাক্তারের বাটিতে যাইতেন না। সামান্য ব্যাধির ঔষধ তাহাদের মুখে এবং পেটরা পুঁটলিতেই থাকিত। ইহা ব্যতীত আর্য স্ত্রীলোকেরা গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্রেরও রীতিমত শিক্ষা করিয়াছেন। লীলাবতী ও খনার কথা মনে করিলে এক্ষণকার পুরুষদের লজ্জা হইবে। যে জাতির মধ্যে বিজ্ঞান শাস্ত্র ও শিল্প বিদ্যার চর্চ্চা নাই, সে জাতীর উন্নতির আশা কোথায় এবং সে জাতির শিক্ষাই বা কোথায়? পুরাকালের কথা মনে করিলে আজ আর্য জাতিরা দেশীয় বিজ্ঞান ও শিল্পে মূর্খ। তথাপি দেশীয় শিক্ষা যাহা আছে, তাহা উৎসাহ বিহীনে লুপ্ত প্রায়। দেশীয় শিল্পের উন্নতিতেই ভারতের উন্নতি।
আজি দেশীয় বিজ্ঞান ও শিল্প অভিধানের শব্দের ন্যায় লোকমুখে উচ্চারিত। আজ ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও শিল্প বিদ্যারই স্রোত ভারতবর্ষে প্রবল বেগে প্রবাহিত। আজিকালি ইউরোপ মহাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্পে শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করিয়াছে। সুতরাং দয়াবান ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট সেই ইউরোপীয় বিজ্ঞান শাস্ত্র ও শিল্পবিদ্যা শিক্ষা দিবার জন্য স্থানে স্থানে কলেজ ও স্কুল স্থাপন করিয়া ভারতবাসীদের মহোপকার করিতেছেন। বঙ্গদেশে বিস্তর বি.এ, এম. এ. দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্ধ হইবার জন্য লালায়িত হইয়াও দাসত্ব পাইতেছেন না। তথাপি নিজ নামের শেষে শুষ্ক বি.এ, এমএ, উপাধি সংযোজিত করিবার জন্য ধন, প্রাণ, মন সমর্পণ করিতেছেন। বিএ, এমএ, পরীক্ষা দিয়া কৃতবিদ্যা হওয়া নিতান্ত ভাল, কিন্তু জীবনযাত্রা নির্বাহ জন্য, সংসারের সমৃদ্ধি লাভের জন্য এবং জাতীয় উন্নতি জন্য বিজ্ঞান শাস্ত্র ও শিল্প বিদ্যায় অনুশীলন করা নিতান্ত প্রয়োজনীয়। দাসত্ব করাই বিদ্যা শিক্ষার মূল, তন্ত্রমন্ত্র হওয়া উচিত নহে। এই সম্বন্ধে আমাদের, মহাত্মা বড়লাট লর্ড কার্জন যাহা বলিয়াছেন, তাহার সেই সারগর্ভ উপদেশে ভারতবাসীদের বিশেষত বঙ্গবাসীদের চৈতন্য হওয়া উচিত।
এই বিজ্ঞান শাস্ত্র ও শিল্প বিদ্যার তরঙ্গ সকল দেশে প্রবাহিত হইতেছে এবং ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের অভিপ্রায়ে সকলেই উৎসাহিত হইতেছে। এমন সময়ে শিক্ষিত দেশ হিতৈষী ভদ্র মণ্ডলীর যত্নে এবং রাজসাহী জেলার বোর্ডের সাহায্যে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারী মাসে ১) রামপুর বোয়ালিয়াতে একটি রেশমী স্কুল স্থাপিত হয়। এই বিদ্যালয়টি “ডায়মন্ড জুবিলী ইন্ডস্ট্রিয়াল স্কুল” নামে প্রসিদ্ধ হয়। এই বিদ্যালয়ে জেলা বোর্ডের সাহায্য থাকিলেও কার্য নির্বাহিকা একটি সভা আছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান, বোয়ালিয়া মিউনিসিপালটীর চেয়ারম্যান, রাজসাহী কলেজের প্রিন্সিপাল এবং অন্যান্য ভদ্রলোক এ সভার সভ্য। জজের উকিলবাবু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বি, এল, এই সভার সম্পাদক। তিনি যেরূপ যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে এই বিদ্যালয়ের উন্নতি জন্য চেষ্টা করিতেছেন, তাহাতে তাহাকে আমি ভূয়সী প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারি না। এ মহৎ কার্যের উপযুক্ত পাত্রই অক্ষয়বাবু। স্বয়ং কালেক্টর মিঃ নন্দকৃষ্ণ বসু এম, এ, সি, এস, এই বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করিয়া জনসাধারণের প্রীতির ভাজন হন। যে স্থানে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহা দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদানাথ রায় বাহাদুরের অধিকার। তিনি এই স্থানের নিজ স্বত্ব দেশ হিতকর বিদ্যালয়ের জন্য দান করিয়াছেন। রাজসাহীর অন্যান্য মহাত্মারাও এই বিদ্যালয়ে বিশেষ সাহায্য করিয়াছেন। যে যে মহাত্মা যত টাকা সাহায্য করিয়াছেন তাহার তালিকা নিম্নে দেওয়া গেল। নাটোর মহারাজা- ৫০০০। রায় কেদারপ্রসন্ন লাহিড়ি বাহাদুর-১৫০০০। রাণী হেমন্তসুন্দরী দেবী-৬০০০। দুবলহাটির রাণীদ্বয় ২০০০। মনোমোহিনী দেবী-৫০০০। চৌগ্রামের রাজা রমণীকান্ত রায়-৫০০। ভুবনমোহন মৈত্র জজের উকিল-৩০০০। এই প্রচুর সাহায্যে ইহা বেশ প্রমাণ হইবে জেলার রাজা জমিদারগণের এই বিদ্যালয়ের উন্নতি জন্য বিশেষ যত্ন আছে। গবর্ণমেন্টের কৃষি বিভাগ হইতেও এই বিদ্যালয়ে সাহায্য দেওয়া হয়। এই বিদ্যালয় হইতে গুটিপোকার বীজ প্রস্তুত করা এবং দেশ বিদেশ পাঠান হইতেছে, সূতা রং করা এবং সূতা প্রস্তুত করিয়া মটকার কাপড় বুনন এই সকল কার্য শিক্ষা হইতেছে। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবু সীতানাথ গুহ। ইনি কৃষি বিভাগের শিক্ষিত পুরুষ। দুই বৎসর হইল এই বিদ্যালয় স্থাপিত। এই অল্পকাল মধ্যে ইহার যশ ও নাম এত বিস্তৃত হইয়াছে যে এই বিদ্যালয় হইতে গুটিপোকার বীজ জাপান, ইতালী, ইংলন্ড এবং ভারতের নানা স্থানে প্রেরিত হইতেছে।২৯ ইহাই বর্তমান রাজসাহীর গৌরব। অক্ষয়বাবু ঠিক বলিয়াছেন যে বাংলার জেলাগুলি মধ্যে উৎকৃষ্ট রেশম প্রস্তুত জন্য রাজসাহী একটি প্রসিদ্ধ জেলা ছিল।২৯ এই গ্রন্থের অনেক স্থলে বলা হইয়াছে যে মহারাণী ভবানীর রাজসাহী রাজ্যে বিস্তর রেশম ও কার্পাস বস্তু প্রস্তুত হইয়া ইউরোপীয় বণিকদের দ্বারা দেশ বিদেশে প্রেরিত হইত। এই রেশমের কার্য নির্বাহার্থ কোন ইউরোপীয় যন্ত্র ছিল না, কেবল হস্ত ও দেশীয় যন্ত্র দ্বারা নির্বাহিত হইত। কিন্তু শিল্পের প্রকৃত উন্নতি সাধন মানসে অক্ষয়বাবু ইউরোপীয় ও দেশীয় উত্তম যন্ত্র প্রয়োগে রেশম কার্য শিক্ষার ব্যবস্থা করিতেছেন। এই নূতন বিদ্যালয়ে রাজসাহীর পুরাতন গৌরবের পুনরুদ্ধারের সূত্রপাত বলিতে হইবে। মহারাণী ভবানীর সময়ের ন্যায় রাজসাহীতে পুনরায় পট্টবস্ত্র ও কার্পাস বস্ত্রের গৌরব বৃদ্ধি হইলে, রাজসাহীবাসীদের সুখ সমৃদ্ধির পরাকাষ্ঠা হইবে তাহার আর ভুল নাই। সে দিন কি আমাদের ভাগ্যে হইবে? রাজসাহীর রাজা জমিদারগণ অধ্যবসায় ও যত্ন করিলে এবং আবশ্যকীয় অর্থব্যয় করিতে কুণ্ঠিত না হইলে, রাজসাহীর সেই শুভদিন অবশ্যই হইবে, তাহার আর কোন সন্দেহ নাই। আমাদের জানা উচিত যে নিম্নশ্রেণির কৃষকেরা তিন টাকায় পাঠশালায় বিদ্যাশিক্ষা করিবে এবং মধ্য ও উচ্চশ্রেণিয়েরা বিজ্ঞান শাস্ত্র ও শিল্প বিদ্যার গূঢ়তন্ত্রে পটু হইয়া স্বদেশের ও স্বজাতির সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিবে।৩০ রাজা ও জমিদারগণ বিজ্ঞান শাস্ত্র ও শিল্পবিদ্যায় শিক্ষিত হইলে নিজ প্রজাগণকে ঐ বিদ্যাশিক্ষায় উৎসাহিত করিয়া তাহাদের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিতে পারেন এবং টেলীমেকসের মেনটরের ন্যায় তাহাদের উপদেষ্টা হইয়া প্রজা হিতকর কার্যে যশলাভ করিতে পারেন। পুরাকালে মনুর বিধানানুসারে রাজাকে কৃষি বিদ্যা, বাণিজ্য ব্যবসা ও শিল্পবিদ্যার গূঢ়তত্ত্ব শিক্ষা করিতে হইত। ৩১ রাজার জ্ঞানের উপর প্রজার সুখ সমৃদ্ধি অনেক পরিমাণে নির্ভর করে। প্রজার সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করাই রাজা জমিদারগণের কর্তব্য। কিন্তু তাহাদিগকে পীড়ন করিয়া ও তাহাদের রক্ত শোষণ করিয়া নিজ কোষ পূরণ করা রাজা জমিদারগণের কর্তব্য কর্ম নহে। প্রজাকে সমৃদ্ধিশালী করাই রাজা জমিদারগণের কর্তব্য কর্ম। বিহার অঞ্চলের প্রজাহিতৈষী মহামান্য রাজা রামপাল সিংহ এবং ঢাকা জেলার অন্তর্গত তেওতা গ্রামের জমিদার রায় পার্বতীশঙ্কর চৌধুরির ন্যায় রাজসাহীর রাজা জমিদার দেশীয় শিল্পের উন্নতি সাধনের যত্নবান হইলে প্রজার সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি হইবে তাহার আর সন্দেহ নাই। ডাকঘর- নিম্নলিখিত পোষ্ট অফিসগুলি রাজসাহী জেলার অন্তর্গত।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















