মালাইতার পরিবর্তিত চিত্র
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ মালাইতা একসময় চীনবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিল। রাজধানী হনিয়ারা থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার ফেরি দূরত্বে অবস্থিত এই দ্বীপ ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের বেইজিংকে স্বীকৃতি ও তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল। তখনকার প্রাদেশিক প্রিমিয়ার ড্যানিয়েল সুইদানি প্রকাশ্যে তাইপেইপন্থী অবস্থান নেন এবং চীনা বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন, চীনের উপস্থিতি দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর চরিত্র পাল্টে দেবে।
কিন্তু ২০২৩ সালে সুইদানিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর চীনের তহবিল প্রবাহিত হতে শুরু করে। এখন দ্বীপের রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে শুরু করে কৃষি উন্নয়ন—সবখানেই চীনের উপস্থিতি চোখে পড়ছে। চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন ইতোমধ্যে ১০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন করছে, যা বেইজিংয়ের প্রথম বড় প্রকল্প। এর পাশাপাশি চাল চাষের নতুন কর্মসূচিও পরিকল্পনায় রয়েছে।
স্থানীয়দের মানসিকতার পরিবর্তন
প্রাদেশিক সহকারী সচিব পিটার হেরেহুরা সম্প্রতি চীনের আমন্ত্রণে বেইজিং ও গুয়াংঝো সফর করেছেন। তিনি জানালেন, স্থানীয়রা ধীরে ধীরে “নতুন বন্ধু” চীনের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। অনেক সময় চীন সরাসরি সম্প্রদায়কে সহায়তা করছে, যা প্রাদেশিক সরকারও জানে না। এতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে।
প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা
মালাইটার এই পরিবর্তন সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও গোটা প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার প্রতিচ্ছবি। ২০১৯ সালের পর থেকে দেশটি বেইজিংয়ের কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে নিরাপত্তা ও পুলিশি সহযোগিতার চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত অবস্থান এবং গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ ও মাছ ধরার এলাকা চীনের নজরে পড়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ গ্রায়েম স্মিথের মতে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চীনের সামর্থ্য প্রদর্শনের কৌশল। এরপর চীন অন্যান্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশকে বলে—”তোমরা চাইলে এই প্যাকেজ থেকে পছন্দমতো অংশ নিতে পারো।”
প্রচলিত অংশীদারদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
চীনের প্রভাব দেখে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী অংশীদাররা নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। জাপান বাজার ও জেটি নির্মাণের পর এবার হাসপাতাল উন্নয়নে কাজ করছে। অস্ট্রেলিয়া, যা এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দাতা, রাস্তা নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করেছে। বিলবোর্ডে তাদের অবদানের বিস্তারিত উল্লেখ করা হচ্ছে—৫ বছরের মধ্যে ৫ বিলিয়ন সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ডলারে ৫৩৯টি প্রকল্প ও প্রায় ১১ হাজার চাকরির প্রতিশ্রুতি।
চীনের “ছোট ও সুন্দর” প্রকল্প
লোই ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, চীন এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক দাতা। তারা অবকাঠামোর পাশাপাশি ছোট আকারের কমিউনিটি প্রকল্পেও জোর দিচ্ছে, যেগুলোকে তারা “ছোট এবং সুন্দর” বলে অভিহিত করছে। সোলার লাইট, পানির ট্যাঙ্ক, মাছ ধরার জাল থেকে শুরু করে খেলাধুলার সরঞ্জাম—চীনা দূতাবাস এসব বিতরণ করছে। তবে স্থানীয় নেতারা বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সুফল আনে এমন প্রকল্পে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
তাইওয়ান ও পুরোনো টানাপোড়েন
তাইওয়ান ও চীনকে ঘিরে দ্বন্দ্ব মালাইতা ও গুয়াডালক্যানাল দ্বীপের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক-সংকটকে আবারও উসকে দিয়েছে। শতাব্দীর শুরুতে এই দ্বন্দ্ব গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, আবার ২০২১ সালে বিক্ষোভকারীরা রাজধানীর চায়না টাউন পুড়িয়ে দেয়। সাবেক প্রিমিয়ার সুইদানির বিরুদ্ধে এখনো অবৈধ সমাবেশের মামলার বিচার চলছে। তিনি বলেন, চীনা সাহায্য প্রবাহিত হলেও স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ নেই। স্থানীয় উদ্যোক্তারা চীনা ব্যবসার দামে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না।
তাইওয়ানের বিদায়েও অনেকেই ক্ষুব্ধ। কৃষক লেনার্ড গোরে তাইওয়ানের কর্মসূচি থেকে কৃষি শিখেছিলেন। সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর সেই সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়, তার এনজিওও টিকে থাকতে পারেনি। এখন তিনি শুধু নিজস্ব কৃষিকাজের মাধ্যমে দিন গুজরান করছেন।
সাহায্যের ওপর অতিনির্ভরতা
লোই ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ বিশ্বের ১২তম সাহায্যনির্ভর দেশ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সমস্যার মূল কারণ দেশের নেতৃত্বের অদক্ষতা।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে মালাইটায় ২৫ মিলিয়ন ডলারের একটি কৃষি ও জীবিকাভিত্তিক কর্মসূচি (SCALE) শুরু করেছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় এসে পুরোনো সহায়তা সংস্থা বন্ধ করে দেওয়ায় এ উদ্যোগ স্থগিত হয়ে যায়। মালাইটার ইউএসএআইড অফিস এখন তালাবদ্ধ, সেখানে ক্রসচিহ্ন আঁকা। স্থানীয়রা বলছেন, এই শূন্যতা কাজে লাগিয়েই চীন তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে।
বিরোধী রাজনীতির উদ্বেগ
বিরোধী নেতা পিটার কেনিলোরিয়া জুনিয়র বলেন, চীন কৌশলগতভাবে মালাইটায় মনোযোগ দিয়েছে। অবকাঠামো, ছোট প্রকল্প ও কর্মকর্তা সফরের মাধ্যমে তারা প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। তার মতে, গণতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর মিল থাকলেও এখন সরকার চীনের দিকে ঝুঁকছে।
বর্তমান সরকারের অবস্থান
প্রধানমন্ত্রী জেরেমিয়া মানায়েলে দায়িত্ব নেওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া সফরকে প্রথম অগ্রাধিকার দেন, এরপর চীন সফর করেন। তার সচিব জিমি রজার্স জানান, দেশটি শুধু চীনের সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং একাধিক অংশীদারের সহায়তা প্রয়োজন। তিনি বলেন, মালাইটায় চীনের কার্যক্রম বেড়েছে বটে, তবে এখনো অনেক রাস্তা উন্নয়নে সহায়তা দরকার।
তার মতে, মালাইতা যদি কোনো দাতার সঙ্গে খুশি থাকে, সেটি গোটা সলোমন দ্বীপপুঞ্জের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে। তিনি উপমা টেনে বলেন—”মালাইতা হাঁচি দিলে, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ কেঁপে ওঠে।”