অর্থনীতি ও সামরিকীকরণের স্থায়ী রূপ
রাশিয়ার অর্থনীতি এখন যুদ্ধক্ষেত্রের অংশ হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ থেমে গেলেও দেশটির অর্থনীতি হয়তো আর কখনোই যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়াতে পারবে না। বিপুল প্রতিরক্ষা ব্যয়ের কারণে দেশটি এমন এক স্থায়ী সামরিকীকরণের মধ্যে ঢুকে গেছে, যা কারখানাগুলোকে রূপান্তরিত করেছে এবং লক্ষাধিক শ্রমিককে টেনে নিয়েছে। এই যুদ্ধশিল্প অর্থনীতিকে পতন থেকে বাঁচালেও এখন এর থেকে পিছু হটা রাশিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পুতিনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্পষ্ট করেছেন যে তিনি প্রতিরক্ষা শিল্পকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখতে চান। পশ্চিমা নেতাদের শঙ্কা, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পুতিন এই সেনাশক্তি ন্যাটোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন। ফলে তার কাছে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী শুধু যুদ্ধক্ষেত্র নয়, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা কৌশলেরও অপরিহার্য অংশ।
উৎপাদনের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি
ইউক্রেন আক্রমণের আগে ২০২৩ সালে রাশিয়া মাত্র ৪০০ সাঁজোয়া যান সরবরাহের পরিকল্পনা করেছিল। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দশ গুণ। একইসঙ্গে, ইরান থেকে আমদানির ওপর নির্ভরশীল না থেকে দেশটি নিজস্ব ড্রোন উৎপাদন শুরু করেছে। ২০২৩ সালে যেখানে ১ লাখ ৪০ হাজার ড্রোন বানানো হয়েছিল, ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৫ লাখ।
যুদ্ধের বিশাল খরচ
২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে অন্তত ২২ ট্রিলিয়ন রুবল (২৬৩ বিলিয়ন ডলার)। আগামী তিন বছরেও এ ব্যয় কমার কোনো লক্ষণ নেই। নিষেধাজ্ঞার কারণে বাজেট চাপের মুখে পড়েছে, তবে প্রতিরক্ষা ব্যয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে অস্ত্র রপ্তানির সম্ভাবনা
সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো রাশিয়াও যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অস্ত্র রপ্তানিকে অর্থনীতির মূলভিত্তি করতে চাইছে। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের গবেষক তাতিয়ানা অর্লোভা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন অস্ত্র ও প্রযুক্তির বিশাল পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। এই প্রযুক্তি যুদ্ধ শেষে রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত হবে।
ইতিমধ্যেই রাশিয়া বিভিন্ন অস্ত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছে—ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ব্রাজিলসহ বহু দেশে। সরকারি রপ্তানি সংস্থা রসঅবোরোনএক্সপোর্ট জানিয়েছে, অস্ত্র রপ্তানির অর্ডার বেড়ে রেকর্ড ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী প্রথম চার বছরে বার্ষিক ১৭ থেকে ১৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র রপ্তানি সম্ভব হবে।
চাহিদা, ঝুঁকি ও পশ্চিমা চাপ
বিশেষ করে বৈশ্বিক দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প খুঁজছে এমন দেশগুলোর কাছে রাশিয়ার অস্ত্রের চাহিদা আছে। দামও তুলনামূলক কম হওয়ায় চুক্তি বাড়তে পারে। তবে পশ্চিমা চাপ অনেক দেশের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে চাপ দিয়েছিল।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
রাশিয়ার সামরিক কারখানাগুলো আপাতত চালু থাকবে এবং কর্মসংস্থান দেবে। তবে রপ্তানি একা এত বড় উৎপাদন ক্ষমতা বজায় রাখতে পারবে না বলে কিছু ছাঁটাই বা বেতন কর্তনের আশঙ্কা রয়েছে। পুতিন অবশ্য মনে করেন প্রতিরক্ষা ব্যয়ে অর্থ নষ্ট হয়নি। তার পরিকল্পনায় প্রতিরক্ষা শিল্পকে বেসামরিক খাতের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে, যাতে জাহাজ নির্মাণ, বিমান, ইলেকট্রনিকস, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও কৃষি খাতেও সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।
পুতিনের কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হলো একটি যুদ্ধ-প্রস্তুত সেনাশক্তি ধরে রাখা। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন যে উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে। রাশিয়ার অর্থনীতি তাই ক্রমেই যুদ্ধ ও শান্তির সীমারেখা মুছে দিয়ে এক ধরনের স্থায়ী সামরিক শিল্পকাঠামোয় রূপ নিচ্ছে।