ব্যবসায়িক মন্দার বাস্তবতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা-পরবর্তী ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের টানাপোড়েন এবং বৈশ্বিক মন্দার ছায়া—সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বলছেন, বাজারে ক্রেতার চাপ কমেছে, উৎপাদন খরচ বেড়েছে, অথচ বিক্রি বাড়ছে না। এই অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ আসছে না, বিদ্যমান ব্যবসাও টিকে থাকার লড়াই করছে।
কর-জিডিপি অনুপাতের সংকট
বাংলাদেশের অন্যতম বড় দুর্বলতা হলো কর-জিডিপি অনুপাত। বর্তমানে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৮-৯ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ভারত, নেপাল কিংবা ভুটানেও এই হার ১২ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে। কর আদায় কম হওয়ার ফলে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও আধুনিক না করলে রাজস্ব ঘাটতি বাড়তেই থাকবে।
আইএমএফের চাপ ও শর্ত
বাংলাদেশ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর আওতায় কর আদায় বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে আরও নমনীয় করার শর্ত দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তুলছে। যদিও সরকার বলছে, দীর্ঘমেয়াদে এসব সংস্কার অর্থনীতিকে আরও টেকসই করবে।
আন্তর্জাতিক তুলনা
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যদি ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপাইনসের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আমরা পিছিয়ে আছি কর কাঠামো ও রপ্তানি বৈচিত্র্যে। ভিয়েতনাম প্রযুক্তি ও শিল্প পণ্যে ব্যাপক বৈচিত্র্য এনেছে, যেখানে বাংলাদেশ এখনও পোশাক শিল্পের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। আবার কর আদায় ও প্রশাসনিক সংস্কারে ইন্দোনেশিয়া যে অগ্রগতি করেছে, বাংলাদেশ সে জায়গায় অনেক পিছিয়ে।
সম্ভাব্য সমাধান
১. কর সংস্কার: ডিজিটাল করব্যবস্থা চালু করে এবং কর ফাঁকি বন্ধ করে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো।
২. রপ্তানি বৈচিত্র্য: পোশাকের বাইরে আইটি, কৃষিপণ্য, ওষুধ এবং হালকা প্রকৌশল শিল্পে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা।
৩. ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন: ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি সহজ করা, দুর্নীতি হ্রাস করা এবং নীতি-সংগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
৪. বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ: অবকাঠামো উন্নয়ন, বন্দর আধুনিকায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে সক্রিয় করা।
৫. সুশাসন নিশ্চিতকরণ: স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সঠিক নীতি প্রয়োগ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে রয়েছে কর-জিডিপি অনুপাতের দুর্বলতা, ব্যবসায়িক মন্দা এবং বৈদেশিক ঋণের চাপ। অন্যদিকে রয়েছে জনসংখ্যার সম্ভাবনা, তরুণ কর্মশক্তি, ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈচিত্র্যময় বাজার। সঠিক সংস্কার ও কার্যকর নীতি গ্রহণ করা গেলে বাংলাদেশ আবারও প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে পারবে।