সারসংক্ষেপ
- • শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে ঘনিষ্ঠ গবেষণার পথিকৃৎ
- • ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি
- • পরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা
- • আফ্রিকায় কাজ করার শৈশবের স্বপ্ন পূরণ
প্রস্থান এক কিংবদন্তির
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও পরিবেশকর্মী জেন গুডঅল ৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন। বুধবার (১ অক্টোবর) তাঁর প্রতিষ্ঠিত জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় বক্তৃতা সফরে থাকার সময় প্রাকৃতিক কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইনস্টিটিউটের বিবৃতিতে বলা হয়, গুডঅলের আবিষ্কার বিজ্ঞানের ধারা বদলে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রকৃতির একনিষ্ঠ রক্ষক ও পরিবেশ পুনর্গঠনের অনবরত কণ্ঠস্বর।
শিম্পাঞ্জিদের জগৎ থেকে বিশ্বমঞ্চে
শৈশব থেকে বন্যপ্রাণীর প্রতি ভালোবাসা তাঁকে নিয়ে যায় ইংল্যান্ডের সমুদ্রতীরবর্তী গ্রাম থেকে আফ্রিকার জঙ্গলে। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক যাত্রা। ১৯৬০-এর দশকে নারী বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি শিম্পাঞ্জিদের আচরণ নিয়ে যে গবেষণা শুরু করেন, তা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে ওঠে।
তিনি সংখ্যার বদলে শিম্পাঞ্জিদের নাম দিয়ে তাঁদের ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক সম্পর্ক ও আবেগকে তুলে ধরেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, মানুষের মতো শিম্পাঞ্জিরাও সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে। এ আবিষ্কার মানবজাতি ও প্রাণিজগতের মধ্যে সীমারেখাকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে।
বিজ্ঞান থেকে পরিবেশকর্মী
গবেষণার পাশাপাশি তিনি বুঝতে পারেন—শুধু শিম্পাঞ্জিদের নয়, তাঁদের আবাসস্থলও দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে। এ উপলব্ধিই তাঁকে জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে যুক্ত করে।
২০২০ সালে সিএনএন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা ভুলে যাচ্ছি যে আমরা প্রকৃতিরই অংশ। এখনো কিছু সময় বাকি আছে।”
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
২০০৩ সালে তিনি ব্রিটিশ এম্পায়ারের ‘ডেম’ খেতাব পান। ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম প্রদান করে।
শৈশবের স্বপ্ন থেকে আফ্রিকার জঙ্গলে
১৯৩৪ সালে লন্ডনে জন্ম নেওয়া গুডঅল বেড়ে ওঠেন ইংল্যান্ডের বোর্নমাউথে। ছোটবেলা থেকেই তিনি বন্যপ্রাণীর সঙ্গে বসবাসের স্বপ্ন দেখতেন। বাবার উপহার দেওয়া খেলনা গরিলা আর ‘টারজান’ ও ‘ডক্টর ডুলিটল’ বই তাঁকে প্রাণীর প্রতি গভীর অনুরাগী করে তোলে।
অর্থাভাবের কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেননি। সেক্রেটারি ও চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর তিনি এক বন্ধুর আমন্ত্রণে কেনিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানেই বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ লুই লিকি ও তাঁর স্ত্রী মেরি লিকির সঙ্গে পরিচয় তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
লিকির তত্ত্বাবধানে তিনি তানজানিয়ার লেক টাঙ্গানইয়িকার কাছে গোম্বে স্ট্রিমে গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে তিনি আবিষ্কার করেন—শিম্পাঞ্জিরা মাংস খায়, যুদ্ধ করে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সরঞ্জাম বানিয়ে ব্যবহার করে।
জঙ্গলের বাইরে বৈশ্বিক ভূমিকা
গবেষণা চালাতে চালাতেই তিনি বুঝতে পারেন কেবল গোম্বের শিম্পাঞ্জিদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। তাই ১৯৭৭ সালে তিনি জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠান শুধু আফ্রিকাই নয়, সারা বিশ্বে পরিবেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে।
তিনি বছরে প্রায় ৩০০ দিন ভ্রমণ করতেন। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক, স্কুল-কলেজে বক্তৃতা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল তাঁর জীবনযাপনের অংশ। মৃত্যুর আগের সপ্তাহেও তিনি নিউইয়র্কে “ক্লাইমেট উইক”-এ বক্তব্য রাখেন।
রুটস অ্যান্ড শুটস ও শিশুদের জন্য আন্দোলন
পরবর্তী সময়ে তিনি শিশুদের পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তুলতে ‘রুটস অ্যান্ড শুটস’ নামের কর্মসূচি চালু করেন। তাঁর গবেষণার নিঃসঙ্গ জীবন থেকে এই সক্রিয় জনসম্পৃক্ততার ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক যাত্রা।
লেখক ও অনুপ্রেরণার উৎস
তিনি ৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালের বই ‘রিজন ফর হোপ: এ স্পিরিচুয়াল জার্নি’ আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয়তা পায়। শিশুদের জন্যও এক ডজনের বেশি বই লিখেছেন।
তাঁর বিশ্বাস ছিল, মানুষ চাইলে পরিবেশের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে। ২০০২ সালে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আশা আছে… এটা আমাদের হাতে, আপনাদের হাতে, আমাদের সন্তানদের হাতে। আমাদের দায়িত্ব পৃথিবীকে সবচেয়ে হালকা পদচিহ্নে রেখে যাওয়া।”
ব্যক্তিজীবন
গুডঅল ও তাঁর প্রথম স্বামী বন্যপ্রাণীর আলোকচিত্রী হুগো ভ্যান লাউইকের সংসারে একটি ছেলে ছিল, যাকে সবাই ‘গ্রাব’ নামে চিনত। তাঁদের বিচ্ছেদ হয় ১৯৭৪ সালে। পরে তিনি ১৯৭৫ সালে ডেরেক ব্রাইসনের সঙ্গে বিয়ে করেন, তবে তিনি ১৯৮০ সালে মারা যান।
বিদায়ের পরও আলোর দিশা
জেন গুডঅলের জীবন ও কাজ শুধু শিম্পাঞ্জিরা বা আফ্রিকার জঙ্গলেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি হয়ে উঠেছেন পরিবেশ আন্দোলনের বৈশ্বিক প্রতীক। তাঁর মৃত্যু এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করলেও তাঁর কাজ ও বিশ্বাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাতে থাকবে।