২০২৫ সালের ভয়াবহ বন্যা পাকিস্তানের জন্য শুধু মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং একটি গভীর অর্থনৈতিক সংকটও বয়ে এনেছে। ইতোমধ্যে এক হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তবে ক্ষতির প্রকৃত চিত্র এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি, কারণ বহু অঞ্চল এখনও পানির নিচে রয়েছে।
কৃষি ও অবকাঠামোর ক্ষতি
বন্যার শুরুতেই পাঞ্জাবে প্রায় ১৩ লাখ একর জমির ধান, ভুট্টা, আখ ও তুলা ডুবে যায়। গোটা দেশে ৯ হাজারের বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবহন অবকাঠামোর বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৬ হাজারেরও বেশি গবাদিপশু মারা যায়। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধাক্কা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতে পাকিস্তানের অর্থনীতি ইতিবাচক গতিতে ছিল। আগস্টে মুদ্রাস্ফীতি ৩ শতাংশে নেমে আসে, যা গত কয়েক মাসের তুলনায় কম। খাদ্যপণ্যের দাম ও বিদ্যুৎ চার্জ কমার ফলে এই ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। কৃষি ও উৎপাদন খাতে উন্নতি এবং সুদের হার কমার কারণে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.২৫ থেকে ৪.২৫ শতাংশের মধ্যে থাকার পূর্বাভাস ছিল।
বাজেট ও বাণিজ্য ঘাটতি
অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ৫.৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩.৯ শতাংশে আনার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু বাণিজ্য খাত ছিল বড় উদ্বেগের জায়গা। জুলাই-আগস্টে আগের বছরের তুলনায় বাণিজ্য ঘাটতি ২৯.৬৩ শতাংশ বেড়ে যায়। আমদানি শুল্ক কমানো এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ার কারণে আমদানি বেড়েছে, অথচ রপ্তানি অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
কৃষি খাতের সংকট
বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্যার কারণে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমে যেতে পারে — ২.২ শতাংশ থেকে কমে ১.১ শতাংশে। তুলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বস্ত্রশিল্পে প্রভাব পড়বে। তুলা আমদানি দ্বিগুণ হতে পারে, যা উৎপাদন খরচ বাড়াবে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়াতে পারে, যা ব্যবসা-বাণিজ্যে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।
বৈদেশিক খাত ও রপ্তানির চাপ
তুলা ও খাদ্য আমদানি বেড়ে যাওয়া এবং কৃষি ও বস্ত্র রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে বাণিজ্য ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, শুধুমাত্র এই বন্যাজনিত প্রভাবে চলতি অর্থবছরে বাণিজ্য ভারসাম্যে ১.৯৩ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এর ফলে রুপির ওপরও চাপ তৈরি হবে।
বাজেট ঘাটতি ও পুনর্গঠনের খরচ
প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী কৃষি বাদ দিয়ে পুনর্গঠন খরচ ধরা হয়েছে ৩৬৪ মিলিয়ন ডলার, যা সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচির এক-দশমাংশের সমান। এতে বাজেট ঘাটতি কমানোর সরকারি প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে।
জরুরি পদক্ষেপ ও নীতিগত সুপারিশ
সরকার ইতোমধ্যে বিলাসপণ্যে কর বাড়িয়ে অর্থ সংগ্রহের চিন্তা করছে, তবে এটি যথেষ্ট নয়। দ্রুত অর্থায়ন দরকার — বিদেশে থাকা প্রবাসীদের সহায়তা এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো হতে পারে:
- • কৃষকদের ভর্তুকিযুক্ত বীজ ও সার সরবরাহ
- • ক্ষতিগ্রস্ত গবাদিপশুর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা
- • ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প খাতে সাময়িক সহায়তা
- • বাস্তুচ্যুত শ্রমিকদের জন্য নগদ বিনিময়ে কর্মসূচি
দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার প্রয়োজন
শুধু স্বল্পমেয়াদি সহায়তা যথেষ্ট নয়। প্রতি কয়েক বছর পরপর পাকিস্তান একই ধরনের সংকটে পড়ছে। তাই দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন —
- • জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো
- • আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা
- • কার্যকর নীতি সমন্বয় ও পর্যবেক্ষণ
- • সুসংগঠিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা
বন্যার ক্ষতি পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ভয়াবহভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষি, শিল্প ও বৈদেশিক খাত — সবখানেই এর প্রভাব পড়ছে। সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আয় ও রপ্তানি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখনই টেকসই সমাধান খোঁজা না হলে, এ ধরনের বন্যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক গতিকে বারবার থামিয়ে দেবে।