০৮:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫

তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ধান উৎপাদন হুমকির মুখে: আমদানি-নির্ভর হয়ে উঠছে বাংলাদেশ

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। দেশের অধিকাংশ মানুষ ভাতকে প্রধান আহার হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধান উৎপাদন নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধানের ফলন কমে আসছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ধানের ঘাটতি মেটাতে আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের সংকেত বয়ে আনছে।

ধান উৎপাদনে তাপমাত্রার প্রভাব

বিজ্ঞানীদের মতে, তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে ধানের উৎপাদন প্রায় ৭% হ্রাস পেতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও ভয়াবহ, কারণ:

  • রাতের অতিরিক্ত তাপ শস্য ভর্তি প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
  • তীব্র গরম ধানের আলোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত করে, ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে।
  • তাপের ধাক্কা সরাসরি উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় ক্ষতি ঘটাচ্ছে।
  • অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও খরা—দুটোই উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
    ফলে কৃষকেরা যতই শ্রম দিচ্ছেন, ততই ধান উৎপাদন কমছে।

উৎপাদনের ঘাটতি ও আমদানি

বাংলাদেশে ধান আবাদ হয় দেশের দুই-তৃতীয়াংশ আবাদযোগ্য জমিতে। তবুও বছরে পর্যাপ্ত ধান উৎপাদন হচ্ছে না। ফলস্বরূপ, প্রায় প্রতি বছরই ধান ও চাল আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানি করছে। শুধু ধান নয়, গম, ভুট্টা, সয়াবিন ও পাম তেলের মতো অন্যান্য খাদ্যপণ্যেও আমদানি-নির্ভরতা বেড়েছে। এ অবস্থা খাদ্য নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি করছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি

তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ধান উৎপাদন কমে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে অতিরিক্ত তাপের কারণে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক দশমিক সাত আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জিডিপির প্রায় শূন্য দশমিক চার শতাংশ।
একই সঙ্গে ধানক্ষেতে কাজ করা কৃষকেরা গরমে শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে থাকছেন। তাদের মধ্যে অবসাদ, উদ্বেগ এবং স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষিকাজও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

কৃষকের অভিযোজন চাহিদা

কৃষকেরা এখন এমন ধান জাতের দাবি করছেন, যা দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং আগেভাগে ফলন দেয়। কারণ গরমের আগেই যদি ফসল ঘরে তোলা যায়, তবে ক্ষতি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে তাপ সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের ওপর জোর দিচ্ছেন গবেষকরা।

খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু আবাদি জমি কমছে এবং তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে চাপ বাড়ছে। আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে।

করণীয় পদক্ষেপ

  • কৃষি গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো।
  • তাপ সহনশীল ধানের জাত দ্রুত উদ্ভাবন ও কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
  • কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  • খাদ্য সংরক্ষণ ও বিতরণে দক্ষ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

বাংলাদেশ এক সময় ধান উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আজ ধান উৎপাদনে বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে। ফলে দেশ ধীরে ধীরে ধান আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়ছে। এখনই যদি কার্যকর নীতি গ্রহণ করা না হয়, তবে খাদ্য নিরাপত্তা ভবিষ্যতে আরও বড় সংকটে পড়বে।

জনপ্রিয় সংবাদ

তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ধান উৎপাদন হুমকির মুখে: আমদানি-নির্ভর হয়ে উঠছে বাংলাদেশ

০৫:৩৮:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। দেশের অধিকাংশ মানুষ ভাতকে প্রধান আহার হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধান উৎপাদন নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধানের ফলন কমে আসছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ধানের ঘাটতি মেটাতে আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের সংকেত বয়ে আনছে।

ধান উৎপাদনে তাপমাত্রার প্রভাব

বিজ্ঞানীদের মতে, তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে ধানের উৎপাদন প্রায় ৭% হ্রাস পেতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও ভয়াবহ, কারণ:

  • রাতের অতিরিক্ত তাপ শস্য ভর্তি প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
  • তীব্র গরম ধানের আলোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত করে, ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে।
  • তাপের ধাক্কা সরাসরি উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় ক্ষতি ঘটাচ্ছে।
  • অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও খরা—দুটোই উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
    ফলে কৃষকেরা যতই শ্রম দিচ্ছেন, ততই ধান উৎপাদন কমছে।

উৎপাদনের ঘাটতি ও আমদানি

বাংলাদেশে ধান আবাদ হয় দেশের দুই-তৃতীয়াংশ আবাদযোগ্য জমিতে। তবুও বছরে পর্যাপ্ত ধান উৎপাদন হচ্ছে না। ফলস্বরূপ, প্রায় প্রতি বছরই ধান ও চাল আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানি করছে। শুধু ধান নয়, গম, ভুট্টা, সয়াবিন ও পাম তেলের মতো অন্যান্য খাদ্যপণ্যেও আমদানি-নির্ভরতা বেড়েছে। এ অবস্থা খাদ্য নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি করছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি

তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ধান উৎপাদন কমে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে অতিরিক্ত তাপের কারণে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক দশমিক সাত আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জিডিপির প্রায় শূন্য দশমিক চার শতাংশ।
একই সঙ্গে ধানক্ষেতে কাজ করা কৃষকেরা গরমে শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে থাকছেন। তাদের মধ্যে অবসাদ, উদ্বেগ এবং স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষিকাজও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

কৃষকের অভিযোজন চাহিদা

কৃষকেরা এখন এমন ধান জাতের দাবি করছেন, যা দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং আগেভাগে ফলন দেয়। কারণ গরমের আগেই যদি ফসল ঘরে তোলা যায়, তবে ক্ষতি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে তাপ সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের ওপর জোর দিচ্ছেন গবেষকরা।

খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু আবাদি জমি কমছে এবং তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে চাপ বাড়ছে। আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে।

করণীয় পদক্ষেপ

  • কৃষি গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো।
  • তাপ সহনশীল ধানের জাত দ্রুত উদ্ভাবন ও কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
  • কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  • খাদ্য সংরক্ষণ ও বিতরণে দক্ষ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

বাংলাদেশ এক সময় ধান উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আজ ধান উৎপাদনে বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে। ফলে দেশ ধীরে ধীরে ধান আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়ছে। এখনই যদি কার্যকর নীতি গ্রহণ করা না হয়, তবে খাদ্য নিরাপত্তা ভবিষ্যতে আরও বড় সংকটে পড়বে।