পাকিস্তানে সৌরশক্তিনির্ভর টিউবওয়েল দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। কৃষকেরা ডিজেল বা বিদ্যুতের উপর নির্ভর না করে সহজেই সৌরপ্যানেল দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ব্যবস্থা করছেন। এতে কৃষিতে খরচ কমছে, উৎপাদন বাড়ছে—কিন্তু একইসঙ্গে পানির স্তর বিপজ্জনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশে এই প্রবণতা ভবিষ্যতের জন্য ভয়ঙ্কর সংকেত দিচ্ছে।
কৃষকের অভিজ্ঞতা
পাঞ্জাবের ৬১ বছর বয়সী কৃষক করমাত আলী আগে গরু-মহিষ বিক্রি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি গবাদি পশু বিক্রি করে সেই অর্থে সৌরপ্যানেল কিনেছেন। এখন সৌরপ্যানেলের মাধ্যমে টিউবওয়েল চালিয়ে সহজে ধানক্ষেতে সেচ দেন। বিদ্যুতের অনিয়মিত সরবরাহ কিংবা ডিজেলের ব্যয়বহুল খরচের ওপর আর নির্ভর করতে হচ্ছে না।
“আগের তুলনায় পানির সরবরাহ অনেক মসৃণ,” বললেন আলী।
সৌরশক্তির প্রসার ও পানির ব্যবহার
২০২৩ সাল থেকে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা ব্যাপক হারে সৌরপ্যানেল ব্যবহার শুরু করেছেন। সস্তা চীনা প্যানেল বাজারে আসায় পরিবর্তন আরও সহজ হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী:
- ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পাকিস্তানে ধানের জমি বেড়েছে ৩০%।
- কম পানি লাগে এমন ভুট্টার জমি কমেছে ১০%।
- আনুমানিক ৬.৫ লাখ টিউবওয়েল এখন সৌরশক্তি দিয়ে চলছে।
অনেক কৃষক নিয়মিত সেচ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন—এক দিনে বহুবারও পানি দিচ্ছেন। আগে যা সম্ভব ছিল না।
বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও অর্থনৈতিক লাভ
জাতীয় শক্তি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কৃষি খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার তিন বছরে ৪৫% কমে যাবে। কারণ, সৌরশক্তিতে সেচ খরচ প্রায় নেই বললেই চলে।
কৃষক মোহাম্মদ নাসিম জানান, গত চার বছরে সৌরপ্যানেল ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি প্রায় ২০ লাখ রুপি (৭ হাজার ডলার) সাশ্রয় করেছেন। উৎপাদনও কিছুটা বেড়েছে এবং ধানের মান উন্নত হয়েছে, ফলে বাজারে ভালো দাম মিলছে।
কেউ কেউ গহনা বা জমি বিক্রি করে, আবার কেউ ঋণ নিয়ে হলেও প্যানেল কিনছেন। অনেক গ্রামে কৃষকেরা একসাথে প্যানেল কিনে ব্যবহার করছেন।
পানির স্তরের বিপজ্জনক পতন
পাঞ্জাবের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০২৪ সালে ৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে, যা সংকটজনক পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গভীর স্তরের (৮০ ফুটের বেশি) পানির অঞ্চল দ্বিগুণ হয়েছে।
পাঞ্জাবের সেচমন্ত্রী কাজিম পিরজাদা বলেছেন, “সৌরশক্তি পরিচ্ছন্ন হলেও এটি পানির স্তরের ওপর চাপ তৈরি করছে।”
সরকারি পদক্ষেপ
সরকারি কর্মকর্তারা এখন এই সংকটে নজর দিচ্ছেন।
- ভূগর্ভস্থ পানি পুনর্ভরণ (Aquifer recharge) পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে।
- পুরোনো অবকাঠামো যেমন ঔপনিবেশিক আমলের রাভি সাইফন পুনরুজ্জীবন করা হচ্ছে।
- বন্যায় কিছু এলাকায় পানির স্তর সাময়িকভাবে ফিরে এসেছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনো সার্বিক নীতি ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের অভাব রয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
সৌরপ্যানেলের দাম ২০১৭ সালের পর থেকে ৮০% কমে যাওয়ায় শুধু পাকিস্তান নয়, ব্রাজিল থেকে শুরু করে ইরাক পর্যন্ত কৃষকেরা সেচের জন্য সৌরশক্তি ব্যবহার করছেন। কিন্তু পাকিস্তান যেহেতু বিশ্বের অন্যতম পানি-সংকটাপন্ন দেশ, তাই এর প্রভাব এখানে অনেক বেশি মারাত্মক হতে পারে।
এদিকে ভারত ইতোমধ্যেই সিন্ধু নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্থগিত করেছে, যা পাকিস্তানের জন্য আরও চাপে ফেলে দিয়েছে।
ভবিষ্যতের শঙ্কা
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইমরান সাকিব খালিদ সতর্ক করে বলেছেন—
“এই প্রবণতা যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে কৃষির ধরণ বদলে যাবে, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।”
অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদে সৌরশক্তি কৃষকদের আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানের কৃষি ও পানিসম্পদ মারাত্মক সংকটে পড়তে পারে।
সারাংশে বলা যায়, সৌরশক্তি পাকিস্তানের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হলেও একইসঙ্গে তা পানিসম্পদকে ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখনই কার্যকর নীতি না নিলে আগামী প্রজন্মকে এর ভারী মূল্য দিতে হবে।