শুল্ক হুমকি ও ইউএসএমসিএ-এর ভূমিকা
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফেরার পর প্রথমেই মেক্সিকো ও কানাডাকে শুল্কের হুমকি দেন। যদিও দশ মাস পরও এই দুই দেশ মোট শুল্ক হারের দিক থেকে বিশ্ব গড়ের (১৭%) তুলনায় অনেক নিচে, প্রায় ১০%-এরও কম পর্যায়ে অবস্থান করছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো ইউনাইটেড স্টেটস-মেক্সিকো-কানাডা এগ্রিমেন্ট (USMCA), যা ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে উত্তর আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (NAFTA)-এর জায়গায় আনা হয়েছিল। এই চুক্তি অনেক পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, ফলে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি আংশিকভাবে সীমিত থেকেছে।
তবে সম্প্রতি ইউএসএমসিএ চাপে পড়েছে। আগামী ১ জুলাই ২০২৬ থেকে শুরু হবে এই চুক্তির প্রথম আনুষ্ঠানিক পুনর্মূল্যায়ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটিই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় কৌশলগত সুযোগ। যদিও ট্রাম্প নিজেই এটি করেছিলেন, এখন তিনি চাইলে পুরোপুরি বদলে ফেলতে বা বাতিল করতে পারেন।
উত্তর আমেরিকার অর্থনীতিতে ইউএসএমসিএ-এর প্রভাব
এই চুক্তি তিন দেশের জন্যই লাভজনক হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইউএসএমসিএ দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ৩২% বেড়ে বছরে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এছাড়া বাইরের দেশগুলো থেকে সরাসরি বিনিয়োগ ২১% বেড়েছে, যা বৈশ্বিক বিনিয়োগের পতনের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে।
মেক্সিকোর এক বাণিজ্য উপসচিব বলেছেন, সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো একে অপরকে চমৎকারভাবে সম্পূরক করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র উচ্চমানের চিপ তৈরি করতে পারে, আর মেক্সিকো করতে পারে নিম্নমানের চিপের সংযোজন।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ও সংঘাত
অর্থনৈতিক বাস্তবতা ইউএসএমসিএ-কে টিকিয়ে রাখলেও ট্রাম্প চুক্তির শর্ত মানছেন না পুরোপুরি।
- তিনি মেক্সিকোর কিছু পণ্যের ওপর ২৫% এবং কানাডার কিছু পণ্যের ওপর ৩৫% শুল্ক বসিয়েছেন, যেগুলো শিগগিরই সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন হবে।
- এমনকি গাড়ি, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের মতো ইউএসএমসিএ-আবৃত পণ্যের ওপরও শুল্ক আরোপ করেছেন।
- জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে এসব শুল্ক বৈধ করা হয়েছে, যদিও গাড়ির জন্য নির্ধারিত কোটা (২.৬ মিলিয়ন গাড়ি) বাস্তবে কার্যকর করা হয়নি।
বর্তমানে অনুমান করা হচ্ছে, ইউএসএমসিএ বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশের ওপরই শুল্কের প্রভাব পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, মেক্সিকান বিয়ার শুল্কমুক্ত হলেও ক্যানের অ্যালুমিনিয়ামের জন্য শুল্ক গুনতে হচ্ছে।
সম্ভাব্য ঝুঁকি ও চুক্তি বাতিলের প্রভাব
চুক্তি পুরোপুরি বাতিল হলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে মেক্সিকোর। তাদের মোট রপ্তানির ৮০%-ই যুক্তরাষ্ট্রে যায়, যা জিডিপির এক-তৃতীয়াংশের সমান। কানাডার তিন-চতুর্থাংশ রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে যায়। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রেরও প্রায় ২০% রপ্তানি মেক্সিকো ও কানাডায় যায়।
তাই বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউএসএমসিএ ২০২৬ সালে আরও ১৬ বছরের জন্য নবায়ন হবে। তবে ট্রাম্প প্রতিবেশীদের ওপর শুল্ক চাপানোর প্রবণতা থামাবেন না।
আলোচনার সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব
- গাড়ি শিল্প: আঞ্চলিক কনটেন্ট নির্ধারণ নিয়ে কানাডা ইতিমধ্যে আপত্তি তুলেছে।
- চীন প্রসঙ্গ: যুক্তরাষ্ট্র চীনা কোম্পানির কার্যক্রম ও মেক্সিকোর বাড়তে থাকা চীন থেকে আমদানি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
- অশুল্ক বাধা:
- মেক্সিকোতে জেনেটিকালি পরিবর্তিত ভুট্টার নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের ক্ষুব্ধ করছে।
- যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার অজুহাতে মেক্সিকোর ফল আমদানি বন্ধ করছে।
- কানাডার দুগ্ধনীতিতে ট্রাম্পের আপত্তি রয়েছে।
কানাডা ও মেক্সিকোর কৌশল
- কানাডা প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সমালোচনা করছে এবং প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি তার নির্বাচনী প্রচারণায় অ্যান্টি-ট্রাম্প অবস্থান নিয়েছিলেন।
- মেক্সিকো উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে মার্কিন স্বার্থে শুল্ক আরোপ করছে। এছাড়া চীন থেকে আমদানি করা গাড়ির ওপর ৫০% শুল্ক বসিয়েছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ যাচাইয়ের একটি প্রক্রিয়াও চালু করেছে।
উত্তর আমেরিকার জন্য সেরা পথ
ট্রাম্পের অস্থিতিশীল নীতির কারণে উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। মেক্সিকো ও কানাডা উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইলেও বাস্তবে তা করা কঠিন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তর আমেরিকার জন্য সবচেয়ে লাভজনক পথ হলো একীভূত বাণিজ্যব্যবস্থা ও মুক্ত বাজার বজায় রাখা। এই কাঠামো যতটা সম্ভব অক্ষুণ্ণ রাখা গেলে সবারই মঙ্গল হবে।