০৭:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি বদলাচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্যের মানচিত্র

বৈশ্বিক বাণিজ্যে নতুন গতি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়া দিয়েছে। শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এখন নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য জোট গঠনে তৎপর হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার মেরকোসুর, ভারত, নিউজিল্যান্ড এমনকি আরব আমিরাতও একের পর এক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করছে।

শুধু গত কয়েক মাসেই ইইউ তিনটি বড় এফটিএ করেছে—মেরকোসুর, মেক্সিকো ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে। বছরের শেষ নাগাদ ভারতের সঙ্গেও একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের পাল্টা কৌশল

ইইউ স্পষ্ট জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ শতাংশ শুল্ককে তারা ‘অন্যায্য’ মনে করছে। একই সঙ্গে তারা চীনের অতিরিক্ত উৎপাদন ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানির সীমাবদ্ধতাকেও মোকাবিলা করতে চায়। ইউরোপ এখন তার রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্য আনতে চাইছে।

ইইউ বাণিজ্য কমিশনার মারোস সেফকোভিচ সংসদে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইইউর বাণিজ্যের ১৭ শতাংশ হলেও বাকি ৮৩ শতাংশের বাজারকে অবহেলা করা যাবে না।

অনিচ্ছুক দেশগুলোর মনোভাব পরিবর্তন

ভারত ও ফ্রান্সের মতো দেশ, যারা আগে বাজার খোলার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল, এখন নরম অবস্থানে এসেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা বলেছেন, যতক্ষণ এফটিএগুলো ডব্লিউটিওর নিয়ম মেনে হবে, ততক্ষণ এগুলো বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক।

তবে বাস্তবতা হলো, নতুন এফটিএর সুফল পেতে সময় লাগবে। শুল্ক কমানো বা অনুমোদনের প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে।

অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

ইইউর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাজার এখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলো মোট জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে ইইউর জিডিপি ০.২% থেকে ০.৩% পর্যন্ত কমতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা। তবে রাজনৈতিক দিক থেকে এফটিএগুলো স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নীতি মোকাবিলায় কাজে দেবে।

ব্রুগেল থিংক ট্যাঙ্কের গবেষক নিকলাস পইতিয়ে বলেন, এসব চুক্তি শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করছে, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা অনিশ্চয়তায় রয়েছে।

Trump May Need a Second Term to See Fruits of His Trade Deals - Bloomberg

ইউরোপের সামনে চ্যালেঞ্জ

ইইউ এখন বিশ্বকে বার্তা দিচ্ছে যে, তারা হবে ‘বিশ্বস্ত বাণিজ্য অংশীদার’। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু চুক্তি করলেই হবে না। ইউরোপকে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়াতে হবে, নইলে স্থবিরতার ঝুঁকি থাকবে।

সেন্টার ফর ইউরোপীয়ান রিফর্মের প্রধান অর্থনীতিবিদ স্যান্ডর টোর্দোয়ার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক আমদানি ঘাটতির অর্ধেকের বেশি বহন করেছে। সেটি হারালে অন্যরা—যেমন ইউরোপ ও জাপান—চাহিদা কোথা থেকে পাবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।

তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিকল্প হতে একমাত্র সক্ষম অর্থনীতি হলো ইউরোপ নিজেই। তাই ইউরোপের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোক্তা চাহিদা বাড়ানো এখন অপরিহার্য।

এই প্রতিবেদনটি দেখাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি কেবল তাৎক্ষণিক বাণিজ্য ক্ষতি নয়, বরং বিশ্বজুড়ে দেশগুলোকে নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে বাধ্য করছে। ইউরোপসহ অন্যান্য অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ হলো—কীভাবে তারা নিজেদের বাজার শক্তিশালী করে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি বদলাচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্যের মানচিত্র

০৪:১৮:২০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫

বৈশ্বিক বাণিজ্যে নতুন গতি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়া দিয়েছে। শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এখন নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য জোট গঠনে তৎপর হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার মেরকোসুর, ভারত, নিউজিল্যান্ড এমনকি আরব আমিরাতও একের পর এক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করছে।

শুধু গত কয়েক মাসেই ইইউ তিনটি বড় এফটিএ করেছে—মেরকোসুর, মেক্সিকো ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে। বছরের শেষ নাগাদ ভারতের সঙ্গেও একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের পাল্টা কৌশল

ইইউ স্পষ্ট জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ শতাংশ শুল্ককে তারা ‘অন্যায্য’ মনে করছে। একই সঙ্গে তারা চীনের অতিরিক্ত উৎপাদন ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানির সীমাবদ্ধতাকেও মোকাবিলা করতে চায়। ইউরোপ এখন তার রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্য আনতে চাইছে।

ইইউ বাণিজ্য কমিশনার মারোস সেফকোভিচ সংসদে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইইউর বাণিজ্যের ১৭ শতাংশ হলেও বাকি ৮৩ শতাংশের বাজারকে অবহেলা করা যাবে না।

অনিচ্ছুক দেশগুলোর মনোভাব পরিবর্তন

ভারত ও ফ্রান্সের মতো দেশ, যারা আগে বাজার খোলার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল, এখন নরম অবস্থানে এসেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা বলেছেন, যতক্ষণ এফটিএগুলো ডব্লিউটিওর নিয়ম মেনে হবে, ততক্ষণ এগুলো বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক।

তবে বাস্তবতা হলো, নতুন এফটিএর সুফল পেতে সময় লাগবে। শুল্ক কমানো বা অনুমোদনের প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে।

অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

ইইউর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাজার এখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলো মোট জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে ইইউর জিডিপি ০.২% থেকে ০.৩% পর্যন্ত কমতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা। তবে রাজনৈতিক দিক থেকে এফটিএগুলো স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নীতি মোকাবিলায় কাজে দেবে।

ব্রুগেল থিংক ট্যাঙ্কের গবেষক নিকলাস পইতিয়ে বলেন, এসব চুক্তি শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করছে, যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা অনিশ্চয়তায় রয়েছে।

Trump May Need a Second Term to See Fruits of His Trade Deals - Bloomberg

ইউরোপের সামনে চ্যালেঞ্জ

ইইউ এখন বিশ্বকে বার্তা দিচ্ছে যে, তারা হবে ‘বিশ্বস্ত বাণিজ্য অংশীদার’। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু চুক্তি করলেই হবে না। ইউরোপকে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়াতে হবে, নইলে স্থবিরতার ঝুঁকি থাকবে।

সেন্টার ফর ইউরোপীয়ান রিফর্মের প্রধান অর্থনীতিবিদ স্যান্ডর টোর্দোয়ার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক আমদানি ঘাটতির অর্ধেকের বেশি বহন করেছে। সেটি হারালে অন্যরা—যেমন ইউরোপ ও জাপান—চাহিদা কোথা থেকে পাবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।

তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিকল্প হতে একমাত্র সক্ষম অর্থনীতি হলো ইউরোপ নিজেই। তাই ইউরোপের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোক্তা চাহিদা বাড়ানো এখন অপরিহার্য।

এই প্রতিবেদনটি দেখাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি কেবল তাৎক্ষণিক বাণিজ্য ক্ষতি নয়, বরং বিশ্বজুড়ে দেশগুলোকে নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে বাধ্য করছে। ইউরোপসহ অন্যান্য অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ হলো—কীভাবে তারা নিজেদের বাজার শক্তিশালী করে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে।