০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

যৌনতার ট্যাবু ভাঙা ও সহমর্মিতার চলচ্চিত্র: অসলো ট্রিলজি

চলচ্চিত্রের অপ্রচলিত শুরু

নরওয়ের পরিচালক ডাগ জোহান হাউগেরুদ-এর নতুন চলচ্চিত্র ড্রিমস–এ কাহিনি শুরু হয় এক চমকপ্রদ পরিস্থিতি দিয়ে। ১৭ বছর বয়সী এক মেয়ে, জোহান্নে, স্বীকার করে যে তার নারী শিক্ষকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সাধারণ চলচ্চিত্রে যেখানে এমন প্রকাশের পর আতঙ্ক, অভিযোগ বা পুলিশের কাছে যাওয়া স্বাভাবিক, হাউগেরুদ এখানে বিষয়টিকে দেখিয়েছেন প্রায় স্বাভাবিক ও ঠান্ডা প্রতিক্রিয়ায়।

মা দাদিকে বলেন, তিনি নিশ্চিত নন, রাগ করা উচিত কি না। যখন মা সন্দেহ প্রকাশ করেন যে মেয়ে হয়তো শিক্ষিকাকে রক্ষা করছে, দাদি হেসে বলেন, ‘‘তুমি অনেক বেশি পডকাস্ট শুনছ।’’


ভালোবাসা, যৌনতা ও স্বপ্ন

এই চলচ্চিত্র ড্রিমস হলো তিন পর্বের প্রকল্প লাভ-সেক্স-ড্রিমস: দ্য অসলো ট্রিলজি–র একটি অংশ। চলচ্চিত্রগুলো যৌনতা ও সামাজিক ট্যাবুকে ভিন্ন দৃষ্টিতে তুলে ধরে। ড্রিমস ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে—বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এটি জিতেছে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার

হাউগেরুদ নিজেই এই ট্রিলজিকে বলেছেন সহমর্মিতার একটি পরীক্ষামূলক প্রয়াস। তার মতে, এটি হয়তো ইউটোপিয়ান বলে মনে হতে পারে, কিন্তু দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই সবকিছু নির্ভর করে।

Dreams' Review: Fact or Autofiction? - The New York Times

সংঘাত নয়, কথোপকথন

এই ট্রিলজির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সংঘাতের অভাব। হাউগেরুদ বিশ্বাস করেন, সিনেমায় চিৎকার-চেঁচামেচি বা তর্ক-বিতর্কের দৃশ্য অনেকবার দেখা হয়েছে। তার কাছে বরং আকর্ষণীয় হলো, যখন চরিত্ররা কথোপকথনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে।


ট্রিলজির তিনটি চলচ্চিত্র

১. লাভ (২০২৪, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল) – এখানে দেখা যায় এক নারী চিকিৎসককে, যিনি ফেরিতে পুরুষদের সঙ্গে গোপনে যৌনসম্পর্ক খোঁজেন।
২. সেক্স (২০২৪, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভাল) – এক চিমনি পরিষ্কারক হঠাৎ এক পুরুষ গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্কের পর নিজের পরিচয় ও সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নে জড়িয়ে পড়ে। আশ্চর্যের বিষয়, চলচ্চিত্রে কোনো ঘনিষ্ঠ দৃশ্য নেই, বরং সম্পর্ক ও পরিচয় নিয়ে কৌতুকপূর্ণ আলাপ।
৩. ড্রিমস (২০২৫, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভাল) – কিশোর-কিশোরীর আবেগময় দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক সমালোচকদের বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছে।

Dreams' Review: The Wrap-Up to Norwegian 'Sex/Love/Dreams' Trilogy

আন্তর্জাতিক প্রশংসা ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

বার্লিন উৎসবের বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি, মার্কিন পরিচালক টড হেইনস, চলচ্চিত্রটির বুদ্ধিমত্তা ও হঠাৎ প্রকাশ পাওয়া সত্যের মুহূর্তকে বিশেষভাবে তুলে ধরেন।

হাউগেরুদ বলেন, তার কাজ বর্তমান বিভক্ত সামাজিক কথোপকথনের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে। তার মতে, আজকের সমাজে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে সহমর্মিতা অবহেলিত হলেও, মানুষ ভেতরে ভেতরে এ বিষয়েই ভাবছে।


নরওয়ের প্রভাব ও নতুন ধারা

নরওয়ের পত্রিকা মরগেনব্লাদেত–এর সমালোচক এলিসে ডিবভিগ উল্লেখ করেন, হাউগেরুদসহ নতুন প্রজন্মের নরওয়েজীয় পরিচালকরা আমেরিকান ধারা থেকে সরে এসে ৭০ ও ৮০ দশকের দেশীয় রাজনৈতিক চলচ্চিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।

তার মতে, হাউগেরুদ বিশেষভাবে নরওয়ের সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্র ও সাম্প্রতিক তেল-সম্পদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্দ্বকে চলচ্চিত্রে ধরেছেন।

Norwegian coming of age film Drømmer wins top prize at Berlinale

নির্মাতার ব্যক্তিগত যাত্রা

ডাগ জোহান হাউগেরুদ এক মেকানিক বাবা ও রেস্তোরাঁকর্মী মায়ের সন্তান। ছোট গ্রামে বেড়ে উঠলেও পরে স্টকহোমে পড়াশোনা করেন। লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ছোট ছোট চলচ্চিত্র বানাতে শুরু করেন। তার দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিওয়ার অব দ্য চিলড্রেন (২০১৯) প্রথম প্রদর্শিত হয় ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে।


চরিত্র ও সহমর্মিতা

অভিনেত্রী এলা ওভারবাই, যিনি ড্রিমস–এ জোহান্নের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, বলেন—হাউগেরুদের চরিত্রগুলো তার নিজের সংবেদনশীলতা থেকে গড়ে ওঠে। তার মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পক্ষে এত নিখুঁতভাবে এক কিশোরীর আবেগ প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে কেবল তার অসাধারণ সহমর্মিতা দিয়েই।

অসলো ট্রিলজি শুধু যৌনতার ট্যাবু ভাঙেনি, বরং সম্পর্ক, পরিচয় ও সামাজিক বাস্তবতাকে নতুন আলোয় দেখিয়েছে। সহমর্মিতা ও মানবিক বোঝাপড়ার এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের বিভক্ত পৃথিবীতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

জনপ্রিয় সংবাদ

যৌনতার ট্যাবু ভাঙা ও সহমর্মিতার চলচ্চিত্র: অসলো ট্রিলজি

০৪:০০:১৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ অক্টোবর ২০২৫

চলচ্চিত্রের অপ্রচলিত শুরু

নরওয়ের পরিচালক ডাগ জোহান হাউগেরুদ-এর নতুন চলচ্চিত্র ড্রিমস–এ কাহিনি শুরু হয় এক চমকপ্রদ পরিস্থিতি দিয়ে। ১৭ বছর বয়সী এক মেয়ে, জোহান্নে, স্বীকার করে যে তার নারী শিক্ষকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সাধারণ চলচ্চিত্রে যেখানে এমন প্রকাশের পর আতঙ্ক, অভিযোগ বা পুলিশের কাছে যাওয়া স্বাভাবিক, হাউগেরুদ এখানে বিষয়টিকে দেখিয়েছেন প্রায় স্বাভাবিক ও ঠান্ডা প্রতিক্রিয়ায়।

মা দাদিকে বলেন, তিনি নিশ্চিত নন, রাগ করা উচিত কি না। যখন মা সন্দেহ প্রকাশ করেন যে মেয়ে হয়তো শিক্ষিকাকে রক্ষা করছে, দাদি হেসে বলেন, ‘‘তুমি অনেক বেশি পডকাস্ট শুনছ।’’


ভালোবাসা, যৌনতা ও স্বপ্ন

এই চলচ্চিত্র ড্রিমস হলো তিন পর্বের প্রকল্প লাভ-সেক্স-ড্রিমস: দ্য অসলো ট্রিলজি–র একটি অংশ। চলচ্চিত্রগুলো যৌনতা ও সামাজিক ট্যাবুকে ভিন্ন দৃষ্টিতে তুলে ধরে। ড্রিমস ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে—বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এটি জিতেছে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার

হাউগেরুদ নিজেই এই ট্রিলজিকে বলেছেন সহমর্মিতার একটি পরীক্ষামূলক প্রয়াস। তার মতে, এটি হয়তো ইউটোপিয়ান বলে মনে হতে পারে, কিন্তু দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই সবকিছু নির্ভর করে।

Dreams' Review: Fact or Autofiction? - The New York Times

সংঘাত নয়, কথোপকথন

এই ট্রিলজির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সংঘাতের অভাব। হাউগেরুদ বিশ্বাস করেন, সিনেমায় চিৎকার-চেঁচামেচি বা তর্ক-বিতর্কের দৃশ্য অনেকবার দেখা হয়েছে। তার কাছে বরং আকর্ষণীয় হলো, যখন চরিত্ররা কথোপকথনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে।


ট্রিলজির তিনটি চলচ্চিত্র

১. লাভ (২০২৪, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল) – এখানে দেখা যায় এক নারী চিকিৎসককে, যিনি ফেরিতে পুরুষদের সঙ্গে গোপনে যৌনসম্পর্ক খোঁজেন।
২. সেক্স (২০২৪, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভাল) – এক চিমনি পরিষ্কারক হঠাৎ এক পুরুষ গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্কের পর নিজের পরিচয় ও সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নে জড়িয়ে পড়ে। আশ্চর্যের বিষয়, চলচ্চিত্রে কোনো ঘনিষ্ঠ দৃশ্য নেই, বরং সম্পর্ক ও পরিচয় নিয়ে কৌতুকপূর্ণ আলাপ।
৩. ড্রিমস (২০২৫, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভাল) – কিশোর-কিশোরীর আবেগময় দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক সমালোচকদের বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছে।

Dreams' Review: The Wrap-Up to Norwegian 'Sex/Love/Dreams' Trilogy

আন্তর্জাতিক প্রশংসা ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

বার্লিন উৎসবের বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি, মার্কিন পরিচালক টড হেইনস, চলচ্চিত্রটির বুদ্ধিমত্তা ও হঠাৎ প্রকাশ পাওয়া সত্যের মুহূর্তকে বিশেষভাবে তুলে ধরেন।

হাউগেরুদ বলেন, তার কাজ বর্তমান বিভক্ত সামাজিক কথোপকথনের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে। তার মতে, আজকের সমাজে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে সহমর্মিতা অবহেলিত হলেও, মানুষ ভেতরে ভেতরে এ বিষয়েই ভাবছে।


নরওয়ের প্রভাব ও নতুন ধারা

নরওয়ের পত্রিকা মরগেনব্লাদেত–এর সমালোচক এলিসে ডিবভিগ উল্লেখ করেন, হাউগেরুদসহ নতুন প্রজন্মের নরওয়েজীয় পরিচালকরা আমেরিকান ধারা থেকে সরে এসে ৭০ ও ৮০ দশকের দেশীয় রাজনৈতিক চলচ্চিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।

তার মতে, হাউগেরুদ বিশেষভাবে নরওয়ের সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্র ও সাম্প্রতিক তেল-সম্পদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্দ্বকে চলচ্চিত্রে ধরেছেন।

Norwegian coming of age film Drømmer wins top prize at Berlinale

নির্মাতার ব্যক্তিগত যাত্রা

ডাগ জোহান হাউগেরুদ এক মেকানিক বাবা ও রেস্তোরাঁকর্মী মায়ের সন্তান। ছোট গ্রামে বেড়ে উঠলেও পরে স্টকহোমে পড়াশোনা করেন। লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ছোট ছোট চলচ্চিত্র বানাতে শুরু করেন। তার দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিওয়ার অব দ্য চিলড্রেন (২০১৯) প্রথম প্রদর্শিত হয় ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে।


চরিত্র ও সহমর্মিতা

অভিনেত্রী এলা ওভারবাই, যিনি ড্রিমস–এ জোহান্নের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, বলেন—হাউগেরুদের চরিত্রগুলো তার নিজের সংবেদনশীলতা থেকে গড়ে ওঠে। তার মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পক্ষে এত নিখুঁতভাবে এক কিশোরীর আবেগ প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে কেবল তার অসাধারণ সহমর্মিতা দিয়েই।

অসলো ট্রিলজি শুধু যৌনতার ট্যাবু ভাঙেনি, বরং সম্পর্ক, পরিচয় ও সামাজিক বাস্তবতাকে নতুন আলোয় দেখিয়েছে। সহমর্মিতা ও মানবিক বোঝাপড়ার এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের বিভক্ত পৃথিবীতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।