প্রাকৃতিক ভারসাম্যের পথে নতুন চিকিৎসা ভাবনা
হ্রদে স্নানের বিপদ
আফ্রিকার বিশাল লেক ভিক্টোরিয়াকে দেখলে মনে হয় গরমের দিনে ঝাঁপিয়ে পড়লেই স্বস্তি মিলবে। কিন্তু সেটি বিপজ্জনক ভুল। হ্রদের জলে ভরপুর ক্ষুদ্র পরজীবী কৃমি—“স্কিস্টোসোম”—যা মানুষের ত্বক ভেদ করে শরীরে ঢুকে যায় এবং লিভার থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলেই দেখা দেয় এক মারণব্যাধি—বিলহারজিয়া।
আফ্রিকাসহ বিশ্বের প্রায় ২০ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর এর কারণে মারা যায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। আরও ভয়াবহ হলো, অনেক আক্রান্তই শিশু—তাদের শারীরিক বিকাশ ও মেধা উভয়ই বাধাগ্রস্ত হয়। এটি সামগ্রিকভাবে দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতিকেও দুর্বল করে তোলে।
চিকিৎসা আছে, কিন্তু প্রতিরোধই শ্রেয়
বিলহারজিয়ার চিকিৎসা সম্ভব হলেও রোগটি পুনরায় ফিরে আসে। অনেক স্থানে ওষুধের সহজলভ্যতাও সীমিত। তাই সংক্রমণ রোধই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
এই প্রেক্ষাপটে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোল্যান্ড প্রাউড এবং তাঁর সহকর্মীদের “PLOS Neglected Tropical Diseases”–এ প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে একটি অভিনব ধারণা—লেক ভিক্টোরিয়ায় বিলুপ্তপ্রায় ক্যাটফিশের সংখ্যা বাড়ালে সংক্রমণ কমতে পারে।
কীভাবে মাছ বাঁচাবে মানুষকে
স্কিস্টোসোম কৃমির জীবনচক্রে দুটি মধ্যবর্তী আশ্রয়দাতা লাগে—একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী (যেমন: মানুষ) এবং একটি জলজ শামুক। যদি শামুকগুলো কমে যায়, তবে কৃমির জীবনচক্রও ভেঙে পড়ে। অতীতে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে শামুক নিধনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাই প্রয়াত বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু ব্রিয়ারলি এবং তাঁর সহকর্মী প্রাউড মনোযোগ দেন প্রকৃতির সহজ সমাধানে—শামুকভুক ক্যাটফিশের সংখ্যা বাড়ানোয়।
ডঃ ব্রিয়ারলি লক্ষ্য করেছিলেন, আফ্রিকার অনেক হ্রদের পাশে ব্যবহৃত কীটনাশকের কারণে শামুকভুক মাছ যেমন ক্যাটফিশ মারা যাচ্ছে। ফলে শামুকের সংখ্যা বেড়ে বিলহারজিয়া ছড়াচ্ছে। তাই বিপরীতভাবে মাছের সংখ্যা বাড়ালে সমস্যাটি কিছুটা কমানো সম্ভব হতে পারে।
লেক ভিক্টোরিয়ায় পরীক্ষামূলক প্রকল্প
দুর্ভাগ্যবশত, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে লেক ভিক্টোরিয়ায় ক্যাটফিশ প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। অতিরিক্ত মাছধরা ও নাইল পার্চ নামের আক্রমণাত্মক মাছের আগমন স্থানীয় প্রজাতির ক্ষতি করেছে।
তাই ডঃ ব্রিয়ারলি ও ডঃ প্রাউড প্রায় ৫০ হাজার ক্যাটফিশ পোনা তৈরি করে তানজানিয়ার উপকূলে তিনটি স্থানে ছেড়ে দেন। আরও চারটি স্থানে কোনো মাছ ছাড়া নিয়ন্ত্রণমূলক পরীক্ষা চালানো হয়। স্থানীয়দের তিন মাস ওই এলাকায় মাছ না ধরার অনুরোধ জানানো হয়। এরপর গবেষকেরা শামুকের সংখ্যা ও স্থানীয় স্কুলের শিশুদের মলের নমুনা সংগ্রহ করে সংক্রমণের হার যাচাই করেন।
ফলাফল আশাব্যঞ্জক
গবেষণায় দেখা যায়, যেখানে ক্যাটফিশ ছাড়া হয়েছিল, সেখানে গড়ে শামুকের সংখ্যা ৫৭ শতাংশ কমেছে এবং শিশুদের মলে পরজীবীর ডিম ৫৫ শতাংশ কম পাওয়া গেছে। বিপরীতে নিয়ন্ত্রণ এলাকায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
অর্থাৎ, অল্প সময়ের মধ্যেই ক্যাটফিশ পুনঃপ্রবর্তন কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। যদিও দীর্ঘমেয়াদে এই পদ্ধতি টেকসই হবে কি না, তা আরও গবেষণার দাবি রাখে—তবে বিলহারজিয়ার মতো দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে এটি এক আশাব্যঞ্জক পথ দেখাচ্ছে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনাই কখনও কখনও রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হতে পারে। লেক ভিক্টোরিয়ায় ক্যাটফিশ ফিরিয়ে আনার এই উদ্যোগ শুধু একটি মাছ সংরক্ষণ প্রকল্প নয়—এটি আফ্রিকার লক্ষ মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য লড়াইয়ের নতুন অধ্যায়।