আকাশে ফিরছে পুরনো অস্ত্র
২০২৪ সালের প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধাভ্যাস ‘ভ্যালিয়ান্ট শিল্ড’-এ এক অভিনব দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। সেখানে একটি সামরিক বেলুন—যার সঙ্গে ছিল ‘ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সেন্সর’—আমেরিকার নতুন প্রিসিশন স্ট্রাইক ক্ষেপণাস্ত্রকে একটি চলমান জাহাজে আঘাত করতে সাহায্য করে।
এই ঘটনার পর ২০২৫ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনী ৪.২ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে তাদের স্থলভিত্তিক ‘এরোস্ট্যাট’ বেলুনগুলোর নজরদারি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য। শুধু আমেরিকা নয়, অন্যান্য দেশও এখন এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হচ্ছে।
পোল্যান্ড রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্তে প্রারম্ভিক সতর্কীকরণ রাডার নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করার জন্য চারটি আমেরিকান এরোস্ট্যাট কিনছে। ইসরায়েল লেবানন সীমান্তে রকেট হামলার পূর্বাভাস পেতে বেলুন মোতায়েন করেছে। ইউক্রেন ড্রোন নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে সিগন্যাল রিলে হিসেবে এগুলো ব্যবহার করছে। কয়েক দশক পর সামরিক বেলুন যেন আবার আকাশে উড়ে উঠছে।
সামরিক বেলুনের ইতিহাস
১৭৮৩ সালে ফ্রান্সে বেলুন আবিষ্কারের পরই এর সামরিক ব্যবহার শুরু হয়। ১৭৯৪ সালে ফরাসিরা একটি হাইড্রোজেন বেলুন যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে বেঁধে অস্ট্রিয়ান সৈন্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধেও গোয়েন্দা বেলুন ব্যবহৃত হয়। ফ্রাঙ্কো–প্রুশীয় যুদ্ধে এই বেলুনে করে প্যারিস থেকে বার্তা পাঠানো হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উভয় পক্ষই শত্রু ট্রেঞ্চ পর্যবেক্ষণে এগুলো ব্যবহার করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমান প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বেলুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সীমিত ভূমিকা পায়—যেমন ‘বেরেজ বেলুন’। ১৯৬০-এর দশকে স্যাটেলাইট গোয়েন্দা নজরদারির যুগ শুরু করে দেয়। তবু আজ, স্যাটেলাইট ও ড্রোনের আধিপত্যের যুগেও আবারও বেলুন ফিরে এসেছে—আরও উন্নত, আরও কৌশলগত ভূমিকায়।
দুই ধরনের সামরিক বেলুন
বর্তমানে ব্যবহৃত সামরিক বেলুন দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—
১। এরোস্ট্যাট (Aerostat) – দড়িতে বাঁধা থাকে এবং ৩–৫ কিলোমিটার উচ্চতায় ভাসে। এটি কম–উচ্চতায় উড়ন্ত ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে সক্ষম। বিমান–ভিত্তিক রাডার বিমানের তুলনায় এটি অনেক সস্তা এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ আকাশে টিকে থাকতে পারে।
২। উচ্চ–উচ্চতার বেলুন (High-altitude Balloon) – এটি দড়িমুক্ত, সাধারণত ২৪ থেকে ৩৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ভাসে। এগুলো স্যাটেলাইটের তুলনায় মাটির কাছাকাছি হওয়ায় ছবি ও ডেটা সংগ্রহে আরও কার্যকর।
দুর্ঘটনা ও অভিজ্ঞতা
২০১৫ সালে আমেরিকার JLENS (Joint Land Attack Cruise Missile Defense Elevated Netted Sensor System) কর্মসূচির একটি বেলুন দড়ি ছিঁড়ে মেরিল্যান্ড থেকে পেনসিলভানিয়া পর্যন্ত ১৫০ কিলোমিটার ভেসে গিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়। ফলে প্রকল্পটি বন্ধ হয়।
তবে আজ সেই ব্যর্থতা অতীত। সীমান্ত নজরদারির কাজে মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন সংস্থা সফলভাবে এরোস্ট্যাট ব্যবহার করছে। মেক্সিকো সীমান্ত ও পুয়ের্তো রিকোর উপকূলে মাদক ও মানবপাচার রোধে এগুলো কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
চীনের প্রভাব: আকাশযুদ্ধের নতুন প্রতিযোগিতা
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক বিশাল চীনা বেলুন মার্কিন আকাশসীমা অতিক্রম করে কয়েকদিন ভেসে বেড়ায়, এরপর সেটিকে গুলি করে নামানো হয়।
এছাড়াও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তাইওয়ান প্রণালীর ওপর শতাধিক নজরদারি বেলুন পাঠিয়েছে। এগুলো স্যাটেলাইটের তুলনায় অনেক নিচু উচ্চতায় ভেসে থাকে এবং অধিক মানসম্পন্ন ছবি ও সংকেত সংগ্রহে সক্ষম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এসব বেলুন বাতাসের দিক অনুমান করে দীর্ঘ সময় নির্দিষ্ট এলাকার ওপর অবস্থান করতে পারে। ফলে গোয়েন্দা কার্যক্রমে এরা এখন স্যাটেলাইটের বিকল্প হয়ে উঠছে—অত্যন্ত কম খরচে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও সামরিক পরিকল্পনা
হাডসন ইনস্টিটিউটের ব্রায়ান ক্লার্ক জানান, বেলুনের ছোট আকারের ইলেকট্রনিক যন্ত্র এখন শত শত কিলোমিটার দূরের সিগন্যাল সংগ্রহ করতে পারে। এগুলো তাপ বা শব্দ উৎপন্ন করে না এবং শনাক্ত করা কঠিন।
আমেরিকার সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে উচ্চ–উচ্চতার বেলুন নিয়ে পরীক্ষা করছে—যুদ্ধক্ষেত্রে একযোগে বহু বেলুন পাঠিয়ে লক্ষ্য শনাক্ত ও অস্ত্রনির্দেশের কাজে ব্যবহারের পরিকল্পনা চলছে।
এমনকি শত্রুপক্ষের গভীরে ড্রোন পৌঁছে দেওয়ার জন্যও বেলুন ব্যবহারের ধারণা বিবেচনাধীন।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে কংগ্রেস পাস করা ব্যয়বিধিতে ৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ হয়েছে পরীক্ষামূলক ‘স্ট্র্যাটোস্ফেরিক বেলুন’ প্রকল্পের জন্য।
সীমাবদ্ধতা ও কূটনৈতিক জটিলতা
অত্যন্ত উচ্চতায় প্রবল বাতাসের কারণে বেলুন নিয়ন্ত্রণ কঠিন। বিদ্যুৎ সরবরাহ সীমিত, কারণ অধিকাংশ বেলুন ছোট সৌর প্যানেলে চলে।
ইলেকট্রনিক যুদ্ধের কারণে যোগাযোগ ব্যাহত হতে পারে। বিদেশি আকাশে গুপ্তচর বেলুন ভূপাতিত হলে তা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিরোধও সৃষ্টি করে।
তবু যুদ্ধক্ষেত্রে বেলুন এখন আবার আলোচনার কেন্দ্রে। ইতিহাসের মতোই, আকাশ আবার পরিণত হচ্ছে এক কৌশলগত যুদ্ধমঞ্চে—যেখানে পুরনো প্রযুক্তি নতুন রূপে ফিরে এসেছে।
পুরনো বেলুন, নতুন প্রতীক
শেষ পর্যন্ত, আকাশে সেই পুরনো বেলুনই এখন আধুনিক সামরিক কৌশলের নতুন প্রতীক। এটি প্রমাণ করছে, কখনো কখনো পুরনো প্রযুক্তিই ভবিষ্যতের যুদ্ধের চাবিকাঠি হতে পারে।