প্রকল্প অর্থ ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্ত
বিশ্বব্যাংক যখন কোনো প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করে, তখন সেই অর্থ কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ব্যবহার করে, যা একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং সচরাচর তথ্যও ভাগ করে না। এই জটিলতা দূর করতে বিশ্বব্যাংক চালু করেছে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম— ফান্ডসচেইন।
এই নিজস্ব ব্লকচেইন-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মটি একটি নিরাপদ ও অপরিবর্তনীয় ডিজিটাল লেজারে প্রতিটি ডলার ট্র্যাক করতে সক্ষম। প্রকল্পের অংশীজনেরা সহজেই এই তথ্য দেখতে পারেন। এর মাধ্যমে লেনদেনের রেকর্ড আরও সহজলভ্য হওয়ায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকই প্রথম বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সংস্থা, যারা প্রকল্প তদারকিতে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে— যা ভবিষ্যৎনির্ভর আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব
ফান্ডসচেইন ব্যবহারের লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাংক গ্রুপের কার্যক্রমকে আরও দ্রুত, কার্যকর ও সুশৃঙ্খল করা, যাতে গ্রাহক ও সম্প্রদায় উভয়ই উপকৃত হয়।
মেট্রো ম্যানিলা ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অর্থ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ লাভেলা টোলেন্তিনো-মোরাদা বলেন, “ফান্ডসচেইন একধরনের সমন্বিত আর্থিক প্রতিবেদন প্ল্যাটফর্ম। এটি তৎক্ষণাৎ অর্থপ্রদানের অগ্রগতি, চুক্তি ও ব্যয় দেখায় এবং সরবরাহকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে জানায় কখন অর্থ ছাড়ের জন্য প্রস্তুত। এতে দলগুলো দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, ফলে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হয়।”
ফিলিপাইনে মেট্রো ম্যানিলা বন্যা ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথম এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার শুরু হয়। ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের এই প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য ম্যানিলার বন্যা ঝুঁকি কমানো ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করা।
বাংলাদেশেও ফান্ডসচেইন ব্যবহৃত হচ্ছে ‘বাংলাদেশ রেজিলিয়েন্স, এন্টারপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড লাইভলিহুড ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’-এ। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ৩,২০০ গ্রামে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি, মাতৃত্বকালীন সহায়তা, স্যানিটেশন উন্নয়ন এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য বৃহত্তর সহায়তা প্রদান করা। ২০২১ সালে শুরু হওয়া ৬০০ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প ইতিমধ্যে ১ লক্ষ ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের সুযোগ দিয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক মাহবুবুল আলম বলেন, “আমরা ৩৫০টি গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে ফান্ডসচেইন চালু করেছি। পাশাপাশি প্রকল্পের সব ৩,২০০ গ্রামে লোন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস) বাস্তবায়ন করছি। নারী নেত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং ল্যাপটপ সরবরাহ করা হয়েছে। যখন ফান্ডসচেইন এলএমএস-এর সঙ্গে যুক্ত হবে, তখন প্রতিটি গ্রামের সংগঠন সরাসরি এই প্রক্রিয়ার অংশ হবে এবং স্বচ্ছভাবে অর্থ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।”
তিনি আরও জানান, “এই সিস্টেমটি আমাদের আর্থিক দলকেও সহায়তা করছে, কারণ এটি সব লেনদেন ডিজিটালাইজ করছে এবং নথি সংরক্ষণ সহজ করছে— বিশেষ করে এমন প্রকল্পে যেখানে সরবরাহকারী ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা অনেক।”
ফান্ডসচেইন কীভাবে কাজ করে
ফান্ডসচেইন মূলত ক্রিপ্টোগ্রাফি, ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির সমন্বয়ে একটি নিরাপদ ও স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। এটি হাইপারলেজার বেসু (Hyperledger Besu) প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যেখানে প্রকল্পে জড়িত সব পক্ষের লেনদেনের তথ্য স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত থাকে। এর মাধ্যমে উন্নয়ন অংশীদাররা পুরো প্রকল্পচক্র জুড়ে অর্থ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারে।
২০২৫ সালে আন্তর্জাতিকভাবে এই প্ল্যাটফর্মটি স্বীকৃতি পায়। ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ট্রাস্টেড ব্লকচেইন অ্যাপ্লিকেশনস’ ফান্ডসচেইনকে ‘সবচেয়ে উদ্ভাবনী সরকারি খাত প্রকল্প’-এর পুরস্কারে ভূষিত করে। একই বছর সিটির (Citi) ‘গ্লোবাল পার্সপেকটিভ অ্যান্ড সলিউশনস’ প্রতিবেদনে একে আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থার রূপান্তরকারী প্রযুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এখন পর্যন্ত ১০টি দেশে ১৩টি প্রকল্পে সফলভাবে ফান্ডসচেইনের ব্যবহার সম্পন্ন হয়েছে— এর মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, কোমোরোস দ্বীপপুঞ্জ, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, মরিশাস, মোলদোভা, মোজাম্বিক ও ফিলিপাইন। ২০২৬ সালের জুন নাগাদ এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ২৫০টি প্রকল্পে সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
দ্রুত ও স্বচ্ছ উন্নয়ন অর্থায়নের পথে
ব্লকচেইন প্রযুক্তিনির্ভর ফান্ডসচেইন ক্রমে আরও বেশি দেশে ও প্রকল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে উন্নয়ন অর্থায়ন আরও দ্রুত, নিরাপদ ও স্বচ্ছ করা সম্ভব হবে— যা মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং পৃথিবী রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।