ভারতের মধ্যপ্রদেশে একাধিক শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। বিষাক্ত কাশির সিরাপের দায়ে এক চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তামিলনাড়ুভিত্তিক এক ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নতুন ল্যাব পরীক্ষায় সিরাপটিতে বিপজ্জনক মাত্রায় শিল্প রাসায়নিক পাওয়া গেছে, যা শিশু মৃত্যুর ঘটনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
ঘটনার সূত্রপাত
মধ্যপ্রদেশে একাধিক শিশুর মৃত্যুর ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করে। পরীক্ষায় দেখা যায়, বাজারে বিক্রি হওয়া কোল্ডরিফ নামের কাশির সিরাপটিতে বিপজ্জনক মাত্রায় শিল্প রাসায়নিক রয়েছে। এর পরেই পুলিশ এক চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে এবং তামিলনাড়ু-ভিত্তিক ‘শ্রেসান ফার্মাসিউটিক্যালস’-এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
চিকিৎসকের গ্রেপ্তার
পারাসিয়ার সিভিল হাসপাতালে কর্মরত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. প্রভীন সোনিকে শনিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি নিজস্ব ক্লিনিকেও চিকিৎসা দিতেন এবং ‘কোল্ডরিফ’ নামে কাশির সিরাপটি শিশুদের প্রেসক্রাইব করছিলেন। এই সিরাপের সঙ্গেই মধ্যপ্রদেশে কমপক্ষে ১৭ এবং রাজস্থানে ৪ শিশুর মৃত্যু যুক্ত রয়েছে।
ব্লক মেডিকেল অফিসার ডা. অঙ্কিত সালাম জানান, “৪ সেপ্টেম্বর এক শিশুর মৃত্যুর পরও তিনি একই সিরাপ প্রেসক্রাইব করতে থাকেন এবং চার বছরের নিচের শিশুদেরও দেন, যাদের জন্য এই ওষুধ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।”
আইনি ব্যবস্থা ও অভিযোগ
পুলিশ ডা. সোনি ও ‘শ্রেসান ফার্মাসিউটিক্যালস’ নামের ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ২৭৬ (ওষুধে ভেজাল) এবং ১০৫ (অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড) অনুসারে মামলা করেছে।
ছিন্দওয়াড়া জেলার পুলিশ সুপার অজয় পাণ্ডে বলেন, “চিকিৎসককে অবহেলার দায়ে এবং বিপজ্জনক ওষুধ ব্যবহারের পরও তা প্রেসক্রাইব করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। কোম্পানির বিরুদ্ধে দূষিত সিরাপ সরবরাহের অভিযোগ আনা হয়েছে।”
মধ্যপ্রদেশ মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় জানায়, ডা. সোনিকে অবিলম্বে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “শিশুদের চিকিৎসায় গুরুতর অবহেলার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”
তামিলনাড়ু সরকারের পদক্ষেপ
তামিলনাড়ু সরকার কোম্পানিটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এম সুব্রামানিয়ান জানান, “কেন তাদের ওষুধ উৎপাদনের লাইসেন্স সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।”
সংবাদ প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, একটি বিশেষ তদন্ত দল (SIT) গঠন করা হয়েছে, যারা শিগগির তামিলনাড়ু গিয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
বিষাক্ত উপাদান ও ল্যাব পরীক্ষার ফলাফল
৪ সেপ্টেম্বর ছিন্দওয়াড়ায় প্রথম শিশু মৃত্যুর খবর আসে, কিন্তু তবুও ওষুধটি বাজারে বিক্রি হতে থাকে। পরবর্তীতে একাধিক রাজ্যে একই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা দেখা দিলে তদন্ত শুরু হয়।
ল্যাব পরীক্ষায় দেখা যায়, কোল্ডরিফ সিরাপে ডাইইথিলিন গ্লাইকল (DEG) নামক এক বিষাক্ত শিল্প রাসায়নিকের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেশি। এই রাসায়নিক সাধারণত ব্রেক ফ্লুইড বা অ্যান্টিফ্রিজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এবং মানবদেহে প্রবেশ করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে।
বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ, কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানা রাজ্যে এই সিরাপের বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মারাত্মক রাসায়নিকের মাত্রা
রাজ্য ওষুধ নিয়ন্ত্রক ডি কে মৌর্য জানান, ওষুধে DEG-এর অনুমোদিত সীমা মাত্র ০.১% হলেও ছিন্দওয়াড়ায় সংগৃহীত নমুনায় এর পরিমাণ পাওয়া গেছে ৪৬.২%। তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরম কারখানার নমুনায় ৪৮.২% পাওয়া গেছে।
তিনি আরও বলেন, “কোল্ডরিফে DEG-এর মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেশি, তবে নেক্সট্রো ডিএস ও মেফটাল সিরাপের নমুনাগুলো নিরাপদ সীমার মধ্যেই রয়েছে।”
নতুন মৃত্যুর খবর
ছিন্দওয়াড়ার পাশের বেতুল জেলায় আরও দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে, যারা ডা. সোনির কাছ থেকে জ্বর ও সর্দির চিকিৎসা নিয়েছিল।
ব্লক মেডিকেল অফিসার ডা. অশোক নারওয়ারে জানান, “দুজন শিশু কল্পেশ্বর ও জামুন বিচ্চুয়া গ্রামের বাসিন্দা। তারা পারাসিয়ায় চিকিৎসা নেয়, কিন্তু কিডনির সংক্রমণে অবস্থার অবনতি হয়। একজন মারা যায় ৮ সেপ্টেম্বর, আরেকজন ১ অক্টোবর।”
যদিও ময়নাতদন্ত হয়নি, তবে চিকিৎসা প্রতিবেদনে গুরুতর কিডনি জটিলতার উল্লেখ আছে। প্রতিবেদনটি মুখ্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
তদন্ত অব্যাহত
পুলিশ বর্তমানে ডা. সোনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, কতজন শিশুকে তিনি এই সিরাপ দিয়েছেন তা জানতে।
এদিকে, ছিন্দওয়াড়া জেলার এক শিশুর দেহ শনিবার কবর থেকে উত্তোলন করা হয়, পরিবারের অনুরোধে ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের জন্য।
ভারতে কাশির সিরাপ নিয়ে এটাই প্রথম বিতর্ক নয়। এর আগে ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের একটি কোম্পানির তৈরি কাশির সিরাপ আফ্রিকার গাম্বিয়ায় শতাধিক শিশুর মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের ওষুধ মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তখন সতর্ক করে জানায়, ডাইইথিলিন গ্লাইকল (DEG) এবং ইথিলিন গ্লাইকল (EG)–এর উপস্থিতি থাকা ওষুধ শিশুদের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। সেই ঘটনার পরও নতুন করে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে।
#কাশির_সিরাপ #শিশু_মৃত্যু #ভারত #তামিলনাড়ু #স্বাস্থ্য_সংকট #ওষুধ_বিপর্যয় #সারাক্ষণ_রিপোর্ট