ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভারতের মৌলিক সীমারেখা ও জাতীয় স্বার্থ কোনো অবস্থাতেই অতিক্রম করা যাবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকা সত্ত্বেও আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধানের পথে রয়েছে।
বাণিজ্য নিয়ে অচলাবস্থা ও ভারতের অবস্থান
জয়শঙ্কর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনায় যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা দুই দেশের সম্পর্কের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। তবে কোনো চুক্তিই ভারতের “লাল রেখা” বা জাতীয় সীমারেখা অতিক্রম করে হতে পারে না।
রবিবার নয়াদিল্লিতে ‘কৌটিল্য ইকোনমিক এনক্লেভ’-এ “অস্থির সময়ের পররাষ্ট্রনীতি” বিষয়ক আলোচনায় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম বাজার, তাই বাণিজ্যিক সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেই আলোচনায় ভারতের মৌলিক স্বার্থ ও নীতি রক্ষা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েনের কারণ
গত দুই দশকে দেখা না-যাওয়া এক ধরনের টানাপোড়েন এখন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে। জয়শঙ্কর বলেন, “আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কয়েকটি ইস্যু রয়েছে, যার বড় অংশই বাণিজ্য আলোচনার অগ্রগতি না হওয়ার কারণে। এই ব্যর্থতার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।”
তিনি আরও জানান, রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ককেও ভারত অন্যায্য বলে মনে করে। জয়শঙ্করের অভিযোগ, “রাশিয়ার সঙ্গে আরও বৈরী সম্পর্ক থাকা অনেক দেশও রাশিয়া থেকে জ্বালানি নিচ্ছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।”
চুক্তি সম্ভব, তবে ভারতের স্বার্থে ছাড় নয়
জয়শঙ্কর বলেন, “যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক বোঝাপড়া হওয়া প্রয়োজন। কারণ এটি শুধু বিশ্বের বৃহত্তম বাজার নয়, বরং বিশ্বের অনেক দেশই ইতিমধ্যেই এমন চুক্তি করেছে। তবে সেটি এমন হতে হবে যেখানে আমাদের মূল সীমারেখাগুলো সম্মানিত হয়। কোনো চুক্তিতেই এমন কিছু থাকা উচিত নয় যা নিয়ে দরকষাকষি করা যায় না।”
তিনি উল্লেখ করেন, মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে, এবং এই আলোচনা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। মোদি ও ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ফোনালাপের পর সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হয়েছে, তবে প্রথম ধাপের চুক্তি শরতের আগেই সম্পন্ন হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
সম্পর্কের অবনতি নয়, আংশিক মতভেদ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করেন, বর্তমান টানাপোড়েনকে সম্পর্কের সার্বিক অবনতি হিসেবে দেখা উচিত নয়। তিনি বলেন, “হ্যাঁ, সমস্যা আছে, কিন্তু কেউ তা অস্বীকার করছে না। আলোচনার মাধ্যমে এসব সমাধান করা হচ্ছে। সম্পর্কের বড় অংশই স্বাভাবিকভাবে চলছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আগের তুলনায় আরও সক্রিয়ভাবে।”
পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
জয়শঙ্কর বলেন, বিশ্ব এখন “একটি অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সময়ের” মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন, সরবরাহ, বাণিজ্য, তথ্য ও জ্বালানি খাতে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম ও প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে, আর নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতাকে এখন খরচের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক জোট ও ক্ষমতার ভারসাম্যও নতুনভাবে নির্ধারিত হচ্ছে। অনেক বড় শক্তি এখন মনে করছে, তারা হয়তো আর বিশ্বের বাকি অংশের ওপর আগের মতো নির্ভরশীল নয়।
চীনের নাম না নিয়েও ইঙ্গিত
চীনের নাম না নিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, “বিশ্বের মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ একটি দেশে স্থানান্তরিত হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এসেছে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন জ্বালানি রপ্তানিকারক শক্তি হিসেবে আত্মনির্ভর হয়েছে, আর চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও যুদ্ধের নতুন রূপ
জয়শঙ্কর বলেন, বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর প্রভাব এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের নজিরও নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রতিযোগিতাও এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
তিনি যোগ করেন, আজকের যুদ্ধের ধরনও বদলে গেছে—আজারবাইজান–আর্মেনিয়া, ইউক্রেন–রাশিয়া ও ইসরায়েল–ইরান সংঘাত দেখিয়েছে যে যোগাযোগবিহীন যুদ্ধ বা দূরপাল্লার অস্ত্র দিয়েও নির্ণায়ক ফল আনা সম্ভব।
ভারতের চ্যালেঞ্জ ও অগ্রযাত্রা
পরিশেষে জয়শঙ্কর বলেন, ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা নয়, বরং এই অস্থির সময়ে আরও উঁচুতে ওঠা। “আমাদের কেবল যা আছে তা রক্ষা করলেই চলবে না; বরং এই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথও খুঁজে নিতে হবে।”
#ভারত #যুক্তরাষ্ট্র #বাণিজ্যচুক্তি #এসজয়শঙ্কর #পররাষ্ট্রনীতি #ট্রাম্প #মোদি #আন্তর্জাতিকসম্পর্ক #চীন #বৈশ্বিকঅর্থনীতি