রাজসাহী প্রদেশ মৎস্য দেশের অন্তর্গত। এই মৎস্য দেশের রাজা বিরাট ছিলেন। তাহার রাজধানী বিরাটনগর, উত্তরবঙ্গ রেলওয়ে স্টেশন পাঁচবিবি হইতে প্রায় ১৭ মাইল দূর। এই নগরে বাস করিয়া, মহারাজ বিরাট স্বীয় শ্যালক সেনাপতি বলবান কীচকের সাহায্যে মৎস্য দেশান্তর্গত রাজসাহী প্রদেশের কেবল যে কর গ্রহণ করিতেন এমত নহে। রথযুথপতি বলবান ত্রিগর্ত রাজ সুশর্মার রাজ্যে, মৎস্যরাজ বিরাট সেই সেনাপতি কীচকের বাহুবলে বারংবার নানা প্রকার উৎপাত করিতেন। যে সময় বিরাট নগরে পঞ্চপাণ্ডবগণ অজ্ঞাত বাস করেন, সেই সময় কীচক দ্রৌপদীর রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হইয়া সেই ললনার কেশাকর্ষণ করিয়া অপমান করাতে মহাবীর ভীমসেন সেই ক্রুর-স্বভাব নিষ্ঠুর পাপাত্মাকে বধ করেন। কীচকের নিধন বার্তা শ্রবণে সুশর্মা সসৈন্যে বিরাট রাজ্য আক্রমণ করেন। কেবল পাণ্ডবগণের বাহুবলেই মৎস্যদেশাধিপতি মহারাজ রিবাট উপস্থিত বিপদ হইতে বিমুক্ত হইয়া গো-ধন রক্ষা করেন এবং নিজ মঙ্গল লাভ করেন। সেই অবধি বিরাটরাজ পাণ্ডবগণের সহিত বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হইয়া বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। বিরাট রাজার সময় হইতে সেই বংশীয় রাজাদিগের সময় পর্যন্ত যে হিন্দু-রাজগণ রাজসাহী প্রদেশের কর গ্রহণ করিতেন, তাহার আর সন্দেহ নাই। বস্তিয়ার লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করার পর হইতে বঙ্গদেশ মুসলমান রাজার অধিকৃত হয়। এই সময় হইতে মুসলমান সম্রাটেরা রাজা জমিদারগণকে শাসনাধীন রাখিয়া রাজসাহীর কর গ্রহণ করিতেন। কিন্তু ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে একজন হিন্দু রাজা গণেশ’ বা কংস বাংলার অধিপতি হন এবং ৯/১০ বৎসর রাজত্ব করেন। তাহার পুত্র জিতমল মুসলমান ধর্ম অবলম্বন করিয়া জেলালুদ্দিন মহাম্মদ সা নাম ধারণ করেন। রাজা গণেশ বা কংস এবং তাহার পুত্র ও পৌত্র ৪০ বৎসর রাজত্ব করেন। তাহাদের রাজ্য করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পুনরায় বঙ্গদেশ মুসলমানদের অধীন হইল। আকবরের সময়ে রাজা তোড়লমল্ল “ওয়াশীল তুমার জমা” নামক হিসাব প্রস্তুত করেন। এই হিসাবে বঙ্গভূমি ১৯ সরকারে ও ৬৮২ মহলে বিভক্ত হয়। এই সময় হইতে বঙ্গদেশের রাজস্ব আদায়ের কিয়ৎ পরিমাণে সুবন্দোবস্ত হয়। আবার আকবরের সময়ে বঙ্গদেশ “বারো ভূঁইয়া” নামক জমিদারেরা অতি পরাক্রমশালী ছিল। এই “বারো ভূঁইয়া” মধ্যে শাঁতুল, তাহিরপুর ও পুঁঠিয়া রাজগণ রাজসাহী অন্তর্গত ছিল। ইহাদের দেওয়ানি ও ফৌজদারি দুই প্রকার ক্ষমতাই ছিল। ইহাদের সৈন্য, গড় আদি ছিল। ইহারা মোঘল সম্রাটকে কর দিতেন।
ন স্ব রা ব ক যুদ্ধ 6
১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে শোভা সিংহ নামক বর্ধমানের জনৈক জমিদার রহিম খাঁ নামক এক পাঠানের সহিত একত্রিত হইয়া বিদ্রোহী হন এবং হুগলি অধিকার করেন। এই সুযোগে ইংরাজেরা “ফোর্ট উইলিয়ম” নামক দুর্গ নির্মাণ করিবার ছল পান। শোভা সিংহ শত্রুর অস্ত্রাঘাতে প্রাণত্যাগ করেন। রহিম খাঁকে দমন করিবার জন্য আরঙ্গজীবের পৌত্র আজিমওযান, ১৬৯৭খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাদার হন। রহিম পরাজিত ও নিহত হইলে বাংলায় শান্তি স্থাপিত হইল। এদিকে ইংরাজেরা ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে আজিমওযানের নিকট হইতে কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি ক্রয় করিয়া সমগ্র ভারতবর্ষ অধিকৃত করিবার সূত্রপাত করিলেন। সেই আজিমওধানের শাসন কালে ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে মরশিদকুলি খাঁ বা জাফর খাঁ নামক এক ব্যক্তি বাংলার দেওয়ান ছিলেন। মুরশিদ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেন; কিন্তু পরে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়া মুরশিদকুলি খাঁ নাম ধারণ করেন এবং স্বীয় কার্যদক্ষতার গুণে আরঙ্গজীবের প্রিয়পাত্র হন। এই মুরশিদকুলি খাঁ কৌশলেই রাজধানী ঢাকা হইতে মুরশিদাবাদে উঠিয়া আইসে। অবশেষে সম্রাট ফেরকসিয়রের সময় সেই মুরিশদ বাংলার সুবাদার হন।
নাটোর রাজবংশের আদিপুরুষ রঘুনন্দন প্রথমত পুঠিয়া রাজসংসারে সামান্য কর্মে নিযুক্ত হন। পরে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণ তাহাক পুঁঠিয়ার রাজসরকারে উকিল নিযুক্ত করিয়া প্রথমে ঢাকায় তদপরে মুরশিদাবাদে নবাবদরবারে পাঠাইয়া দেন। মুরশিদাবাদে নবাবদরবারে রঘুনন্দন স্বীয় বুদ্ধি কৌশলে ক্রমে “নায়েব কানুনগোর” পদ এবং “রায় রায়ান” উপাধি প্রাপ্ত হন। এই সময় রঘুনন্দন মুরশিদকুলি খাঁর প্রিয়পাত্র হইয়া তাহার অনুগ্রহে অনেক জমিদারি লাভ করেন। তাহার সমস্ত জমিদারি তাহার ভ্রাতা রামজীবনের নামে গৃহীত হইয়াছিল।
ভারতবর্ষের চতুর্দিকে ইংরাজ, ফরাসি, ওলন্দাজ ও অন্যান্যা ইউরোপীয় বণিকগণ বাণিজ্যবিস্তার ছলে রত্নপ্রসবিণী ভারত ভূমিকে অধিকার করিবার জন্য মনে মনে সংকল্প করিতেছিলেন। এই সময় আরঙ্গজীবের পৌত্র আজিমওযান বাংলার শাসনকর্তা হইলেও, মুরশিদকুলি খাঁ বাংলার প্রকৃত কর্তা ছিলেন। তখন মুরশিদাবাদে তাহার রাজধানী। তাহারই দৌহিদ্র সৈয়দ রেজা খাঁ বাংলায় দেওয়ানি করিতেন। ইহাদের দুই জনেরই অযথা অত্যাচারে হিন্দু জমিদারগণ অত্যন্ত প্রপীড়িত এবং ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। লজ্জা, অপমান ও কষ্টে জমিদারগণ নিজ নিজ মৃত্যু কামনা করিতে লাগিলেন। এই সময় রাজসাহীর জমিদার রাজা উদিত (উদয়) নারায়ণ নিজ বীরত্ব প্রকাশ করিতেছিলেন।
রাজা উদিত (উদয়) নারায়ণ রায় মুরশিদাবাদের বড় নগরের নিকটস্থ বিনোদলালা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উদিতনারায়ণকে কেহ কায়স্থ কেহ ব্রাহ্মণ বংশীয় বলেন। যে সময় মুরশিদকুলি খাঁ বাংলার নবাব হইয়া মুরশিদাবাদে অবস্থিতি করিতেছিলেন, সেই সময় উদিত নারায়ণের প্রতি এক অতি বিস্তীর্ণ জমিদারি শাসনের ভার ছিল। সমগ্র রাজসাহী চাকলা তাহার দ্বারা শাসিত হইত। তাহার জমিদারি পদ্মা নদীর উভয় পারে বিস্তৃত ছিল। বর্তমান মুরশিদাবাদ, বীরভূম, সাঁওতাল পরগণা, রাজসাহী, বগুড়া, মালদহ, পাবনা জেলার অধিবাসীগণ ও রঙ্গুর ও দিনাজপুর জেলার কতক অধিবাসী তাহাকে রাজস্ব প্রদান করিত। তাহার সমস্ত জমিদারির নাম রাজসাহী। বহু বিস্তৃত জমিদারি বিনা গোলযোগে শাসন করায় এবং সুচারুরূপে শাসন কার্য নির্বাহ করায়, নবাব মুরশিদকুলি খাঁ তাহার প্রতি প্রথমে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। তাহার প্রতি নবাব এইরূপ কিছুদিন সন্তুষ্ট ছিলেন। চিরকাল কাহার সমান যায় না। উদিতনারায়ণের ভাগ্যলক্ষ্মী ক্রমে অন্তর্হিত হইতে লাগিল। তাহার সৌভাগ্যের ক্রমেই হ্রাস দৃষ্টি হইতে লাগিল। অবশেষে বাংলা ১১২০ সাল অর্থাৎ ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজসাহীর জমিদার উদিতনারায়ণ নবাবের কর্মচারীগণের অত্যাচারে উৎপীড়িত হইয়া নিজ অনুচরবর্গ সমবেত করিয়া বিদ্রোহী হন এবং যুদ্ধে পরাজিত হইয়া সুলতান-বার পর্বতে প্রস্থান করেন। নাটোর বংশের আদিপুরুষ রঘুনন্দন তাহাকে ধৃত করিয়া বন্দি করিয়া আনিলে, তাহার পুরস্কার স্বরূপ তাহার ভ্রাতা রামজীবনকে সমগ্র রাজসাহীর জমিদারি প্রদান করা হয়।