সঙ্গীতজগতের এক আত্মার যাত্রা
সুপার হেডলাইন:
‘কমোডোরস’ থেকে বিশ্বজয়, তারপর আত্মবিশ্লেষণের পথে—লাইওনেল রিচির ‘ট্রুলি’ বইতে উঠে এসেছে সাফল্য, ব্যর্থতা ও পুনর্জন্মের কাহিনি।
লিড:
গায়ক, গীতিকার ও সুরস্রষ্টা লাইওনেল রিচি তাঁর নতুন আত্মজীবনী ‘ট্রুলি’তে তুলে ধরেছেন জীবনের আলোক-অন্ধকারের গল্প। কমোডোরস ব্যান্ডের গৌরব থেকে ব্যক্তিগত ভাঙন—সবই তিনি লিখেছেন খোলামেলা ভাষায়, যেন এক সুরেলা জীবনকথা।
সঙ্গীত জীবনের দুই সত্য
বিখ্যাত গায়ক ও গীতিকার লাইওনেল রিচি বলেন, তাঁর জীবনের দুটি সত্য আছে। এক, কমোডোরস ব্যান্ড না থাকলে ‘লাইওনেল রিচি’ও থাকত না। আর দুই, গান লেখা শুরু করার পরই তিনি নিজের ভেতরের ভাঙাচোরা লেখকঅংশগুলো মেরামত করতে পেরেছিলেন।
তাঁর নতুন আত্মজীবনী ‘ট্রুলি’ (প্রকাশক: হারপার কলিন্স, ৪৯৬ পৃষ্ঠা) বইটিতে রিচি নিজের জীবনের নানা উত্থান-পতন খোলামেলা ভাবে তুলে ধরেছেন। গান, ভালোবাসা, ব্যর্থতা ও পুনর্জন্ম—সবকিছুর কাহিনি তিনি সাজিয়েছেন কবিতার মতো সাবলীল ভাষায়।
এক হাসির আড়ালের মানুষ
সবসময় হাস্যোজ্জ্বল এই তারকাকে দেখে অনেকেই ভাবেন, তাঁর জীবনে হয়তো কষ্ট বলে কিছু নেই। কিন্তু ‘ট্রুলি’ বইয়ে রিচি জানিয়েছেন, তিনি যেমন সফল সঙ্গীতশিল্পী, তেমনি জীবনে ভুলও করেছেন, সম্পর্কেও ব্যর্থ হয়েছেন।
চারটি পর্বে লেখা বইটির নাম দেওয়া হয়েছে:
১. অরিজিন স্টোরি (১৯৪৯–১৯৭০)
২. লিফটঅফ (১৯৭০–১৯৮২)
৩. ফ্লাইং সলো (১৯৮২–১৯৯৯)
৪. রিইনভেনশন (১৯৯৯–বর্তমান)
প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি গল্পের ছলে বলেছেন কীভাবে বর্ণবৈষম্যের আমেরিকায় টাসকিগির ছোট শহর থেকে উঠে এসে বিশ্বখ্যাত শিল্পী হয়েছেন।
কমোডোরস ব্যান্ডের সাফল্যের সূচনা
১৯৭১ সালে কমোডোরস ব্যান্ড তখনও বড় কোনো নাম নয়। সেই সময় মোটাউন রেকর্ডসের প্রভাবশালী কর্মকর্তা সুজান দে পাসে তাঁদের একটি নিউ ইয়র্ক ক্লাবে পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ হয়ে জ্যাকসন ফাইভ ব্যান্ডের ওপেনিং অ্যাক্ট হিসেবে সুযোগ করে দেন। তখন মাইকেল জ্যাকসনের বয়স মাত্র ১২।
রিচি মুগ্ধ হন জ্যাকসনের কণ্ঠের বিশুদ্ধতা ও পরিণত ভাব দেখে। ব্যাকস্টেজে পরিচয়ের সময় জ্যাকসন রিচির নাম উচ্চারণ করেন “লাই-নেল,” যা তিনি পরবর্তী ৩৯ বছর একইভাবে বলতেন।
এই ট্যুরই কমোডোরসকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয়।
‘থ্রি টাইমস আ লেডি’: এক পারিবারিক টোস্ট থেকে জন্ম
১৯৭৮ সালে রিচি তাঁর বাবার একটি টোস্ট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন ‘থ্রি টাইমস আ লেডি’ গানটি। তাঁর বাবা মা’কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “তিনি এক মহান নারী, মহান মা এবং মহান বন্ধু।” এই তিন গুণের কথাই গানে রূপ নেয়।
রিচি প্রথমে গানটি ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার জন্য লিখেছিলেন, কিন্তু প্রযোজক জেমস অ্যান্থনি কারমাইকেল তাঁকে রাজি করান কমোডোরসের জন্যই গানটি রাখতে। পরে এটি ব্যান্ডটির প্রথম নাম্বার ওয়ান হিট হয়।
বছর শেষে বেভারলি হিলস হোটেলে সিনাত্রার সঙ্গে দেখা হলে তিনি রিচিকে বলেন, “বালক, তোমার শুধু একটাই গান নয়, আরও অনেক আছে—আর সবগুলোই তুমি লিখেছ।”
‘হ্যালো’ ও ‘অল নাইট লং’-এর জন্ম
কমোডোরস ব্যান্ড ভাঙনের মুখে থাকলেও রিচি তখনো গান লিখতেন। ১৯৮২ সালে নিজের প্রথম একক অ্যালবামের কাজ চলাকালে একদিন পিয়ানো বাজাতে বাজাতে তিনি বলেন, “Hello, is it me you’re looking for?” প্রযোজক কারমাইকেল তাঁকে গানটি শেষ করতে বলেন। কিন্তু রিচির কাছে এটি ছিল “সবচেয়ে কর্নি লাইন”। পরে এটি তাঁর অ্যালবাম ‘Can’t Slow Down’-এ জায়গা পায় এবং বিশ্বব্যাপী হিট হয়।
একই সময়ে “All Night Long” গানটির ধারণা আসে এক জ্যামাইকান বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার সময়। তিনি বলেন, “আমাকে আবার কাজে ফিরতে হবে, all night long।” সেই মুহূর্তে জন্ম নেয় তাঁর সিগনেচার হিট—“All Night Long।”
প্রিন্স, শিলা ই. ও নিকোল রিচির দত্তক গ্রহণ
১৯৮৪ সালে রিচি ব্যান্ডে পারকাশনিস্ট শিলা ই.-কে নেন। তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন গায়ক প্রিন্স। এক কনসার্টে রিচি ও তাঁর স্ত্রী ব্রেন্ডা হার্ভি দেখেন একটি ছোট মেয়ে একা ট্যাম্বুরিন বাজাচ্ছে। সে ছিল শিলা ই.-এর ভাই পিটার এসকোভেডোর মেয়ে নিকোল।
পারিবারিক অস্থিরতার কারণে রিচি দম্পতি মেয়েটিকে সাময়িকভাবে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। পরে নয় বছর বয়সে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিকোল রিচিকে দত্তক নেন। রিচি লেখেন, “নিকি আমার জীবনের আলো হয়ে উঠেছিল।”
ভেঙে পড়া মানসিক অবস্থা ও পুনর্জাগরণ
১৯৯০ সালে বাবার মৃত্যু, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ এবং গলার সমস্যার চিকিৎসায় বারবার ব্যর্থতা রিচিকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। তিনি একসময় একা জামাইকায় গিয়ে পাঁচ দিন সমুদ্রতীরে বসে থাকেন, পান করেন, আর চিন্তা করেন জীবনের অর্থ নিয়ে।
তিনি লেখেন, “এটাই আসলে এক নার্ভাস ব্রেকডাউনের চিত্র।” ঠিক সেই সময় এক স্থানীয় ভক্ত এসে বলেন, “আপনাকে বাঁচতেই হবে, কারণ আপনি আমাদের আশার আলো।” সেই কথাই রিচিকে নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়।
‘ট্রুলি’ শুধু একজন সঙ্গীতশিল্পীর আত্মজীবনী নয়, এটি এক জীবনের সংগ্রাম, প্রেম, হারানো ও পুনরুদ্ধারের গল্প। লাইওনেল রিচি তাঁর সঙ্গীতের মতোই এই বইয়ে জীবনের সুর ছুঁয়েছেন—যা পাঠকের হৃদয়েও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিধ্বনি তোলে।
#ট্রুলি #লাইওনেলরিচি #সারাক্ষণরিপোর্ট #সঙ্গীতজীবনী #আমেরিকানসংগীত-