বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়ে উঠছে মিষ্টি পানি—যা শুধু জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদান নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন ও বিনিয়োগ কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। তবুও বৈশ্বিক পানির স্বল্পতা ও অব্যবস্থাপনা এখন এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটের রূপ নিচ্ছে, যার বার্ষিক ক্ষতি হতে পারে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত।
বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রাণশক্তি: মিষ্টি পানি
মিষ্টি পানি এখন শুধু জীবনের অপরিহার্য উপাদান নয়, এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদও বটে। কৃষি, শিল্প, খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পানিই ভিত্তি। ২০২২ সালে বৈশ্বিক মিষ্টি পানির বাজারের মূল্য ছিল ৮৪৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩০ সালে বেড়ে ১.১৪২ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে এই আশাবাদের পেছনে রয়েছে গভীর সংকট। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ২৪০ কোটি মানুষ পানির স্বল্পতার অঞ্চলে বসবাস করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মিষ্টি পানির চাহিদা সরবরাহের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি শুধু পরিবেশগত নয়, অর্থনৈতিক সংকটও সৃষ্টি করবে।
স্থায়ী সম্পদ হিসেবে পানির গুরুত্ব
বিশ্ববাজারে স্বর্ণ, তেল বা ডিজিটাল মুদ্রার দামের ওঠানামা চললেও পানি মানবজাতির একমাত্র স্থায়ী সম্পদ। এই সম্পদ বছরে ৫৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক মূল্য সৃষ্টি করে। কিন্তু পানির নিরাপত্তাহীনতার কারণে বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ, অর্থাৎ বছরে ১০.২ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে।
এই ঝুঁকি কমাতে আর্থিক খাতের বড় ভূমিকা রয়েছে। অনেক কোম্পানি তাদের বিনিয়োগে পানিবিষয়ক ঝুঁকি বিবেচনায় নেয় না, ফলে তা শেয়ারমূল্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদি পানি-নির্ভর সম্পদ হিসেবে বিনিয়োগ বিবেচনা করা হয়, তাহলে টেকসই অর্থনৈতিক মডেল তৈরি সম্ভব।
বিনিয়োগ ঘাটতির সংকট
বর্তমানে পানি অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের যে পরিমাণ প্রয়োজন, তা বিদ্যমান বিনিয়োগের তিন গুণ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য, SDG অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে বছরে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দরকার।
যেখানে অধিকাংশ প্রতিযোগিতা দেখা যায় পানির সরবরাহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে, সেখানে পানির উৎস বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা প্রায় নেই। লবণাক্ত পানি বিশুদ্ধ করার প্রযুক্তি যেমন ব্যয়বহুল ও শক্তি-নির্ভর, তেমনি হিমবাহের পানি আহরণ অনেক বেশি টেকসই ও সাশ্রয়ী বিকল্প হতে পারে।
গ্লেসিয়ারের সংকট ও গ্রিনল্যান্ডের উদাহরণ
গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহ দ্রুত গলছে। ২০১৯ সালেই প্রায় ৫৩২ ট্রিলিয়ন লিটার মিষ্টি পানি সমুদ্রে মিশে গেছে। এটি একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্বে পানির অভাব সৃষ্টি করছে—একটি ভয়াবহ বৈপরীত্য।
এই পরিস্থিতিতে থমাস শুমান ক্যাপিটাল (TSC) “প্রজেক্ট গ্রিনল্যান্ড” শুরু করেছে, যার লক্ষ্য হিমবাহ থেকে বিশুদ্ধ পানি আহরণ করে খরাপ্রবণ অঞ্চলে সরবরাহ করা। এতে পৃথিবীর মোট মিষ্টি পানির মজুদ প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এই হিমবাহের পানি প্রায় কোনো প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই ব্যবহারযোগ্য, ফলে শক্তি খরচ ও ব্যয় দুই-ই কম। এটি “ইনল্যান্ড আইস” নামে প্রিমিয়াম পানীয় হিসেবেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে, বিশেষত ডেনমার্কের শেফ ও সোমেলিয়েদের মধ্যে।
নতুন বিনিয়োগ মডেল: পানি এখন অবকাঠামো
TSC পানিকে পণ্যের পরিবর্তে বিনিয়োগের উপযুক্ত অবকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করছে। তারা দুটি উদ্ভাবনী প্রকল্প চালু করেছে—
১. গ্লোবাল ওয়াটার সিকিউরিটি ইনডেক্স।
২. থমাস শুমান ওয়াটার সিকিউরিটি ফান্ড।
প্রথমটি এমন কোম্পানিগুলোর মূল্যায়ন করে যারা পানি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখাচ্ছে। দ্বিতীয়টি বিনিয়োগকারীদের জন্য এমন একটি তহবিল, যেখানে টেকসই পানির ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা কোম্পানিগুলোর শেয়ার অন্তর্ভুক্ত।
এসব উদ্যোগ পরিবেশ, সমাজ ও সুশাসনের (ESG) মানদণ্ডের পাশাপাশি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৬ ও ১৩ (পানি ও জলবায়ু) বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে।
মেনা অঞ্চলের সংকট
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (MENA) অঞ্চল এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬.৩ শতাংশ মানুষ এখানে বসবাস করলেও, এই অঞ্চলে মাত্র ১.৪ শতাংশ মিষ্টি পানি রয়েছে। প্রজেক্ট গ্রিনল্যান্ডের মতো উদ্যোগ MENA অঞ্চলে পানির ঘাটতি মোকাবিলায় বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে।
এই প্রকল্প শুধু পানীয় জলের ঘাটতি মেটাবে না, বরং মানবিক সহায়তা, কৃষি ও সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদনের মতো খাতেও নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
৮০০ কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে, পানিই একমাত্র স্থায়ী সম্পদ। আগামী পাঁচ বছরই হবে সিদ্ধান্তমূলক। আমরা চাইলে পানিকে সংকট হিসেবে নয়, টেকসই উন্নয়নের অনুঘটক হিসেবে দেখতে পারি।
থমাস শুমান ক্যাপিটালের দৃষ্টিভঙ্গি হলো: পানিকে পণ্য নয়, অবকাঠামো হিসেবে বিনিয়োগ করা। এতে কেবল অর্থনৈতিক লাভ নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকেও সংরক্ষণ করা সম্ভব।
এখনই সময় পদক্ষেপ নেওয়ার।
#পানি_সংকট #বৈশ্বিক_অর্থনীতি #টেকসই_উন্নয়ন #গ্রিনল্যান্ড #হিমবাহ #জলবায়ু_পরিবর্তন #বিনিয়োগ #ESG #সারাক্ষণ_রিপোর্ট