গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘিরে নতুন আশার আলো
লিড:
গাজা যুদ্ধের অবসান ঘিরে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও মিসরের ত্রিপক্ষীয় প্রচেষ্টা। হামাস ইতোমধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং নীতিগতভাবে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সতর্ক করেছেন, হামাস যদি গাজার ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজি না হয়, তবে তাদের “সম্পূর্ণ ধ্বংসের” মুখে পড়তে হবে। গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে তিনি যে নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, সেটি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও মিসর সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
রবিবার এক সিনিয়র হামাস কর্মকর্তা জানান, দলটি যুদ্ধের অবসান ও বন্দি বিনিময়ের ব্যাপারে “খুবই আগ্রহী” এবং এই বিষয়ে মিসরে আলোচনাও শুরু হয়েছে। হামাস ইতোমধ্যে ট্রাম্প প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আলোচনার নতুন ধাপ
মিসরে অনুষ্ঠিতব্য আলোচনায় হামাস ও ইসরায়েলি প্রতিনিধিরা যুদ্ধবিরতির বিস্তারিত চূড়ান্ত করার চেষ্টা করবেন। ট্রাম্প রবিবার জানান, “আলোচনা এখনই শুরু হয়েছে, এটি কয়েকদিন চলবে।” তাঁর মতে, কয়েকদিনের মধ্যেই হামাসের শান্তির অঙ্গীকার স্পষ্ট হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওও বলেন, “যদি বন্দি মুক্তি প্রক্রিয়া কার্যকর করতে হয়, ইসরায়েলকে আগে বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে হবে।”
যুদ্ধবিরতির পথে অগ্রগতি, তবে এখনও অনিশ্চয়তা
হামাসের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর ট্রাম্প ইসরায়েলকে বোমা হামলা বন্ধের আহ্বান জানান। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে সম্মতি দেন। তবে বাস্তবে গাজায় ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে—বিশেষ করে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়গুলো এখনও অনির্ধারিত।
অতীতের মতোই, আশঙ্কা রয়ে গেছে যে নতুন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও তা ভঙ্গ হতে পারে, যেমন ২০২৩ সালে দুইবারের বিরতি ব্যর্থ হয়েছিল।
ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা: মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির প্রচেষ্টা
ট্রাম্পের দাবি, তাঁর ২০ দফা পরিকল্পনার লক্ষ্য কেবল গাজা নয়, বরং “পুরো মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা”। তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া বার্তায় তিনি বলেন, “এটি গাজার বিষয় নয়—এটি বহু বছরের কাঙ্ক্ষিত মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির বিষয়।”
তবে পরিকল্পনার স্পষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। প্রস্তাব অনুযায়ী, উভয় পক্ষ সম্মত হলে যুদ্ধ অবিলম্বে শেষ হবে। তবু হামাস সবগুলো দফায় সরাসরি সম্মতি দেয়নি; তারা জানিয়েছে, মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে বিস্তারিত আলোচনায় অংশ নেবে।
বন্দি বিনিময় ও মানবিক বাস্তবতা
পরিকল্পনা অনুযায়ী, চুক্তি কার্যকর হলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত ও মৃত বন্দিদের ফেরত দিতে হবে। তবে গাজার ধ্বংসস্তূপে মৃতদেহ উদ্ধার করতে সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েলের দাবি, ২০২৩ সালের অক্টোবরের হামলায় অপহৃত ২৫১ জনের মধ্যে এখনও ৪৮ জন গাজায় রয়েছেন, যাদের মধ্যে ২০ জন জীবিত।
হামাস ও ইসরায়েলের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ
দুই পক্ষই এখন ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছে, তবে এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট।
নেতানিয়াহু সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ধরে রাখার পাশাপাশি তাঁর জোটের ডানপন্থী অংশকে সন্তুষ্ট রাখার কৌশল নিচ্ছেন।
অন্যদিকে, হামাস বন্দি মুক্তিতে রাজি হয়ে আলোচনার কেন্দ্র স্থানান্তর করতে চায় কাতার, মিসর ও অন্যান্য আরব মধ্যস্থতাকারীদের দিকে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক আমজাদ ইরাকি বলেন, “হামাস আসলে ‘হ্যাঁ, কিন্তু’ কৌশল নিয়েছে—যার মাধ্যমে তারা বলটি ফেরত দিয়েছে নেতানিয়াহু ও আরব দেশগুলোর কোর্টে।”
হামাসের প্রতিক্রিয়া ও ট্রাম্প পরিকল্পনার তুলনা
১. বন্দি বিনিময়: হামাস পরিকল্পনার ভিত্তিতে জীবিত ও মৃত ইসরায়েলি বন্দিদের ফেরাতে রাজি, তবে “মাঠপর্যায়ের প্রয়োজনীয় শর্ত” পূরণের কথা বলেছে—যা স্পষ্ট নয়।
২. ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার: হামাস বলেছে, যুদ্ধ শেষ হলে ইসরায়েল সম্পূর্ণভাবে গাজা থেকে সরে যাবে; অথচ ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে।
৩. ভবিষ্যৎ প্রশাসন: হামাস জানিয়েছে, তারা গাজার প্রশাসন হস্তান্তর করবে একটি ফিলিস্তিনি প্রযুক্তিবিদ-নেতৃত্বাধীন কর্তৃপক্ষের কাছে, যার পেছনে থাকবে আরব ও ইসলামি সমর্থন। তবে ট্রাম্প পরিকল্পনায় এই কর্তৃপক্ষকে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে পরিচালনার কথা বলা হয়েছে, যেখানে ট্রাম্প ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার নেতৃত্ব দেবেন।
৪. হামাসের ভবিষ্যৎ ভূমিকা: হামাস নিজেকে বৃহত্তর ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক কাঠামোর অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছে, কিন্তু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে কিছু বলেনি, যদিও ট্রাম্প পরিকল্পনা হামাসকে গাজার শাসন থেকে বাদ দেয়ার কথা বলেছে।
শান্তির পথে জটিল বাস্তবতা
ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গাজা যুদ্ধের অবসান ও বন্দি বিনিময়ের সম্ভাবনা তৈরি হলেও তা বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি প্রক্রিয়ার শুরু মাত্র—শেষ নয়।
#ট্রাম্প #হামাস #গাজা_যুদ্ধ #ইসরায়েল #শান্তি_পরিকল্পনা #সারাক্ষণরিপোর্ট