দুই বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী গাজা যুদ্ধের অবসান চেষ্টায় মিসরের শার্ম আল-শেইখে মুখোমুখি হলো ইসরায়েল ও হামাসের প্রতিনিধিরা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় শুরু হওয়া এই আলোচনাকে অনেকে “শেষ সুযোগ” হিসেবে দেখছেন। তবে মূল দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তা শর্ত নিয়ে জট এখনো কাটেনি।
আলোচনার নতুন অধ্যায়: মিসরে মুখোমুখি দুই পক্ষের প্রতিনিধি
মিশরের শার্ম আল-শেইখে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় শুরু হলো ইসরায়েল ও হামাসের প্রথম পর্বের পরোক্ষ আলোচনা। উদ্দেশ্য: দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধের অবসান। আলোচনায় অংশ নেয় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতার।
প্রথম দিনের বৈঠকে উভয় পক্ষ নিজেদের দাবি-দাওয়া স্পষ্ট করে। হামাস বলেছে, বন্দিমুক্তির পর যেন ইসরায়েল আলোচনায় নির্ধারিত শর্ত ভঙ্গ না করে, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে হবে। অন্যদিকে ইসরায়েল জোর দিয়েছে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ও নিরস্ত্রীকরণের ওপর।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা ও আশাবাদ
ট্রাম্পের প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি, বন্দিমুক্তি ও মানবিক সহায়তা পুনরায় চালুর কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ আরব ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোও এই পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, “আমি সত্যিই মনে করি আমরা একটি স্থায়ী চুক্তির পথে এগোচ্ছি, এবার গাজায় শান্তির বাস্তব সুযোগ এসেছে।”
তবে পূর্বের ব্যর্থ প্রচেষ্টার মতো এবারও বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্ন রয়ে গেছে—যেমন ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের সময়সূচি, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব।
গাজায় যুদ্ধের গতি কমলেও থামেনি হামলা
আলোচনার সময় ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলার মাত্রা কিছুটা কমালেও তা পুরোপুরি বন্ধ করেনি। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন—যা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর গড়ের এক-তৃতীয়াংশ।
গাজা নগরীতে সোমবার রাতেও বিস্ফোরণ ও ধ্বংসের শব্দ শোনা গেছে, যা যুদ্ধবিরতির পথে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে।
হামাসের দাবি: সম্পূর্ণ প্রত্যাহার ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি
একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা জানান, হামাস তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে—ইসরায়েলকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পুরো গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এছাড়া বন্দিমুক্তির তালিকা ও রাজনৈতিক বন্দিদের নাম নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা চলছে।
ইসরায়েলি পক্ষ জানায়, তারা “হলুদ রেখা” পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করতে রাজি—যা ট্রাম্পের প্রস্তাবিত প্রথম ধাপ। পরবর্তী ধাপে পূর্ণ প্রত্যাহার নির্ভর করবে হামাসের শর্তপূরণের ওপর।
যুদ্ধের দুই বছর: ধ্বংস, ক্ষুধা ও আশ্রয়হীন মানুষ
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলে ১,২০০ জন নিহত ও ২৫১ জন বন্দি হয়েছিলেন—যা ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন। প্রতিশোধমূলক অভিযানে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং ২২ লাখেরও বেশি গাজার বাসিন্দা এখন গৃহহীন ও অনাহারে।
গাজার এক তরুণী, ঘারাম মোহাম্মদ বলেন, “চুক্তি হলে হয়তো বাঁচব। না হলে মৃত্যুদণ্ডই আমাদের ভাগ্য।”
আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা
ইসরায়েলের প্রতিনিধি দলে রয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও শিন বেতের কর্মকর্তারা, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা ও বন্দি সমন্বয়ক গাল হির্শ। পরে কৌশলগত বিষয়ক মন্ত্রী রন ডেরমার যোগ দেবেন বলে জানা গেছে।
হামাসের প্রতিনিধিদল নেতৃত্ব দিচ্ছেন নির্বাসিত নেতা খলিল আল-হাইয়া, যিনি এক মাস আগে দোহায় বিমান হামলা থেকে বেঁচে যান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন ট্রাম্পের উপদেষ্টা ও জামাতা জ্যারেড কুশনার এবং বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ।
কঠিন শর্ত ও সন্দেহভাজন বাধা
হামাস সূত্র জানিয়েছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনায় থাকা “নিরস্ত্রীকরণ” ধারা সবচেয়ে বিতর্কিত। হামাসের বক্তব্য—ইসরায়েল দখলদারিত্ব শেষ না করা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা অস্ত্র ছাড়বে না।
একই সঙ্গে ট্রাম্পের নির্ধারিত ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দিমুক্তির সময়সীমা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে মধ্যস্থতাকারীরা, কারণ অনেক বন্দি হয়তো ইতোমধ্যেই নিহত, যাদের মরদেহ উদ্ধার সময়সাপেক্ষ হতে পারে।
জাতিসংঘের আহ্বান ও সামনে পথ
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ট্রাম্পের পরিকল্পনা একটি সুযোগ এনে দিয়েছে, যা কাজে লাগাতে হবে—এই বেদনাদায়ক সংঘাতের সমাপ্তির জন্য।”
মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফা আলোচনায় অংশ নেবে উভয় পক্ষ। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, যুদ্ধবিরতির পথে এখনও অনেক বাধা বাকি, এবং দ্রুত কোনো সমাধান পাওয়া কঠিন।
#গাজা_যুদ্ধ #ইসরায়েল_হামাস #শান্তি_আলোচনা #ট্রাম্প_পরিকল্পনা #মধ্যপ্রাচ্য_সংঘাত #সারাক্ষণরিপোর্ট