২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত নির্বাচনের মুখোমুখি বিহার। মাত্র দুই দফায় ভোট হবে নভেম্বরের ৬ ও ১১ তারিখে। এই নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক জোটগুলোর নয়, বরং নীতীশ কুমারের নেতৃত্ব, আরজেডির ভোটঘাঁটি ও বিজেপির ক্রমবর্ধমান শক্তির বড় পরীক্ষাও।
বিহারে ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত নির্বাচন
বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন এবার অনুষ্ঠিত হবে মাত্র দুই দফায় — ৬ ও ১১ নভেম্বর। ২০২০ সালে তিন দফা, ২০১৫ সালে পাঁচ দফা এবং ২০১০ সালে ছয় দফায় ভোট হয়; তার তুলনায় এটি হবে গত দুই দশকের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ভোটযুদ্ধ।
এই নির্বাচন হবে নীতীশ কুমার নেতৃত্বাধীন জেডিইউর রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার বড় পরীক্ষা। দলটি বারবার জোট পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখলেও তাদের আসনসংখ্যা ও ভোটের হার ক্রমেই কমেছে। গত দুই নির্বাচনে জেডিইউ হারিয়েছে মাটি — একদিকে সহযোগী বিজেপির কাছে, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী আরজেডির কাছে।
নিচে বিহারের ২৪৩ আসনের বিধানসভা নির্বাচনের সাম্প্রতিক ইতিহাস ও প্রধান দলগুলোর অবস্থান তুলে ধরা হলো।
২০১০ সালের নির্বাচন: জেডিইউ – বিজেপির সোনালি যুগ
১৯৯০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত লালু প্রসাদ ও রাবড়ি দেবীর আরজেডি শাসনের পর, ২০০৫ সালের নির্বাচনে বিহার ঝুঁকেছিল এক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে। তিন দফা ভোটের পর ঝুলন্ত অবস্থায় পড়ে রাজ্য, আর পরে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়। একই বছরের দ্বিতীয় নির্বাচনে জেডিইউ – বিজেপি জোট বিজয়ী হয়ে নীতীশ কুমার প্রথমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হন।
২০১০ সালের নির্বাচনে এই জোট রেকর্ড জয় পায়। জেডিইউ পায় ১১৫টি আসন ও ২২.৫৮% ভোট, আর বিজেপি জেতে ৯১ আসন ও ১৬.৪৯% ভোট। জেডিইউ লড়েছিল ১৪১টি আসনে, বিজেপি ১০২টিতে। বিপরীতে, আরজেডি – এলজেপি জোট জেতে মাত্র ২৫টি আসন — আরজেডি ২২টি, এলজেপি ৩টি। যদিও আরজেডি লড়েছিল ১৬৮টি আসনে ও পেয়েছিল ১৮.৮৪% ভোট, যা তখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কংগ্রেস লড়েছিল সব ২৪৩ আসনে, কিন্তু জিতেছিল মাত্র ৪টি, ভোট শেয়ার ৮.৩৭%।
২০১৫ সালের নির্বাচন: আরজেডি – জেডিইউ – কংগ্রেস ‘মহাগঠবন্দন’-এর উত্থান
২০১৪ সালে এনডিএ ছাড়ার পর নীতীশ কুমার ২০১৫ সালে হাত মেলান পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে। এই ‘মহাগঠবন্দন’ বিশাল জয় পায় — মোট ১৭৮টি আসন ও ৪১.৮৪% ভোট। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল সাফল্যের পর এটি ছিল বিরোধী শিবিরের বড় পুনরুত্থান।
সে নির্বাচনে আরজেডি হয় আসনসংখ্যায় বৃহত্তম দল — ৮০টি আসন ও ১৮.৩৫% ভোটে। জেডিইউ পায় ৭১টি আসন ও ১৬.৮৩% ভোট। উভয় দলই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ১০১টি আসনে। কংগ্রেস লড়েছিল ৪১টি আসনে, জেতে ২৭টি, ভোট শেয়ার ৬.৬৬%।
অন্যদিকে, এনডিএ জোট পায় মাত্র ৫৮টি আসন ও ৩৪.০৮% ভোট। তবে ভোটের হিসেবে বিজেপি ছিল এগিয়ে — ২৪.৪২%, যা আরজেডির চেয়ে ছয় শতাংশ বেশি।
২০২০ সালের নির্বাচন: নীতীশ টিকে থাকলেও বিজেপির উত্থান
২০২০ সালের নির্বাচনে এনডিএ গঠিত হয় বিজেপি, জেডিইউ, এলজেপি ও আরও দুটি ছোট দলের অংশগ্রহণে। জোটটি অল্প ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় — ১২৫টি আসন ও ৩৭.২৬% ভোটে। তবে সবচেয়ে বড় চমক ছিল বিজেপির উত্থান — ১১০ আসনে লড়ে ৭৪টি জয় ও ১৯.৪৬% ভোট পেয়ে তারা হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। জেডিইউ পায় মাত্র ৪৩টি আসন (১১৫ আসনে লড়ে) ও ১৫.৩৯% ভোট, তবুও নীতীশ ষষ্ঠবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হন।
আরজেডি, কংগ্রেস ও বামদের জোট পায় ১১০টি আসন ও ৩৭.২৩% ভোট, অর্থাৎ এনডিএর তুলনায় অল্প কম। আরজেডি লড়েছিল ১৪৪টি আসনে, জেতে ৭৫টি ও পায় ২৩.১১% ভোট — যা ছিল রাজ্যের সর্বোচ্চ। বাম দলগুলো মিলে পায় ১৬টি আসন ও ৪.৬৪% ভোট। কংগ্রেস সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় পড়ে — ৭০ আসনে লড়ে মাত্র ১৯টি জয় ও ৯.৪৮% ভোট পায়।
নীতীশের দফায় দফায় জোটবদল
২০২০ সালের পরবর্তী দুই বছরে নীতীশ এনডিএ ছেড়ে ফের যোগ দেন মহাগঠবন্দনে, আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে সরকার গঠন করেন। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে লোকসভা নির্বাচনের আগে আবারও এনডিএতে ফিরে আসেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগে। গত দশ বছরে এটি ছিল তাঁর চতুর্থবারের মতো জোট পরিবর্তন।
বর্তমানে ২৪৩ সদস্যের বিহার বিধানসভায় জেডিইউর রয়েছে ৪৫টি আসন ও বিজেপির ৭৮টি। তাদের যৌথ সংখ্যা ১২৩, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সীমা (১২২)-এর ওপরে। অন্যদিকে আরজেডি, কংগ্রেস ও বাম দলগুলোর মোট আসন ১১৪ — মাত্র আট আসন কম।
আসন্ন নির্বাচনে মূল প্রশ্ন
আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দুটি — আরজেডি কি ধরে রাখতে পারবে তাদের ২৩% ভোট, আর বিজেপি কি এবার পেরোবে সেই সীমা? একই সঙ্গে দেখা যাবে, নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন জেডিইউ কি তাদের রাজনৈতিক ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে পারে, নাকি এই সংক্ষিপ্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে বিহারের রাজনীতি নতুন মোড় নেবে।
#বিহারনির্বাচন #আরজেডি #বিজেপি #নীতীশকুমার #জেডিইউ #ভারতরাজনীতি #নির্বাচন২০২৫ #বিহাররাজনীতি #মহাগঠবন্দন #সারাক্ষণরিপোর্ট