লাদাখে নতুন অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় পরীক্ষার ভঙ্গুরতা প্রকাশ
ভারতের হিমালয়ের শান্ত মরুভূমি লাদাখে আবারও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যের দাবিতে বিক্ষোভ, পুলিশের গাড়িতে আগুন, চারজন নিহত ও বহু আহত হওয়ার ঘটনায় কেঁপে উঠেছে লেহ শহর। আরও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ম্যাগসেসে পুরস্কারজয়ী পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুকের গ্রেপ্তার—যা দিল্লির ‘লাদাখ মডেল’-এর ভঙ্গুর বাস্তবতা উন্মোচন করেছে।
দীর্ঘ শান্তির পর হঠাৎ বিস্ফোরণ
একসময় লাদাখ ছিল ভারতের সবচেয়ে শান্ত অঞ্চলগুলোর একটি। কিন্তু ২৪ সেপ্টেম্বরের সহিংসতা সেই শান্ত চিত্র বদলে দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা লেহ শহরে পুলিশ গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়; প্রাণ হারান চারজন, আহত হন অনেকে।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে যখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নেতা সোনম ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনা দিল্লির লাদাখ নিয়ে রাজনৈতিক পরীক্ষার ভঙ্গুরতা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে।

রাজ্যের দাবিতে উত্তাল লাদাখ
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীর থেকে আলাদা হয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে লাদাখের জন্ম হয়। তখন ধারণা ছিল, এতে উন্নয়ন ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা আসবে। কিন্তু ছয় বছর পর স্থানীয়দের ক্ষোভ তীব্র।
তাদের দাবি—শুধু চাকরি নয়, পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা, নির্বাচিত বিধানসভা, ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় স্বশাসনের অধিকার, ভূমি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।
ওয়াংচুক তাঁর ১৪ দিনের অনশন ধর্মঘটে সতর্ক করেছিলেন—“অবহেলা চলতে থাকলে নেপাল ও বাংলাদেশের তরুণদের মতোই জেনারেশন-জেড বিদ্রোহ দেখা যাবে।”
কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই পরিণত হয় সহিংসতায়। ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (NSA), অভিযোগ—“উসকানিমূলক বক্তব্যে জনতা সহিংসতা ঘটানো।” তাঁকে রাজস্থানের যোধপুর জেলে পাঠানো হয়।
সরকারি নজরে ‘ষড়যন্ত্র’, পরিবারের অভিযোগ ‘হেনস্তা’
লাদাখের পুলিশপ্রধান এস. ডি. সিং জামওয়াল দাবি করেছেন, ওয়াংচুকের পাকিস্তান-যোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি অংমো বলেন, “এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া কিছু নয়।”

তাঁর পরিচালিত অলাভজনক সংস্থা হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অব অল্টারনেটিভ লাদাখ (HIAL)-এর জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। অন্য সংস্থা SECMOL—যার প্রেরণায় তৈরি হয়েছিল জনপ্রিয় সিনেমা থ্রি ইডিয়টস—তারও বিদেশি অনুদান গ্রহণের অনুমতি (FCRA লাইসেন্স) বাতিল করা হয়েছে।
ওয়াংচুকের বক্তব্য, “SECMOL কোনো অনুদান নেয়নি, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় সংস্থার প্রকল্প ফি হিসেবে পাওয়া অর্থ দেশে কর দিয়ে ব্যয় হয়েছে।”
প্রত্যাশা থেকে বঞ্চনার পথে লাদাখবাসী
প্রথমদিকে লাদাখের মানুষ আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল, কারণ এতে তারা জম্মু-কাশ্মীরের জটিল রাজনীতির বাইরে থাকতে পারবে বলে মনে করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আশাবাদ বদলে যায় আশঙ্কায়।
কারণ রাজ্যের কোনো বিধানসভা নেই, রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর প্রকাশের পথও সীমিত। আগে লাদাখ থেকে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় চারজন এমএলএ নির্বাচিত হতেন; এখন সেই সুযোগ নেই। লাদাখ স্বশাসিত পাহাড়ি উন্নয়ন পরিষদ (LAHDC)-এর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ কেবল সড়ক, পানি ও বিদ্যুতেরও মতো মৌলিক বিষয়ে।
২০২০ সালের নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হলেও প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই অপূর্ণ রয়ে গেছে। ফলে ২৪ সেপ্টেম্বর পরিষদ ভবন ও বিজেপি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।

ধর্ম ও রাজনীতি পেরিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন
লাদাখের দুই জেলাই—মুসলিমপ্রধান কারগিল ও বৌদ্ধপ্রধান লেহ—এখন একই দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। লেহ অ্যাপেক্স বডি (LAB) ও কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (KDA)-এর নেতৃত্বে সব দল ও নাগরিক সংগঠন এখন আন্দোলনে।
২৮ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “লাদাখের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।” তিনি রাজ্যের মর্যাদা ও ষষ্ঠ তফসিলের দাবিকে সমর্থন করেন।
অন্যদিকে, কেন্দ্র সরকারের আলোচনার উদ্যোগ বারবার ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছেন, সমাধানের পথে না গিয়ে সরকার শুধু সময়ক্ষেপণ করছে।
আলোচনার স্থবিরতা ও সরকারি শঙ্কা
গত মে মাসে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি লাদাখের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে কিছু পদক্ষেপ নেয়—
- • ১৫ বছরের ধারাবাহিক বসবাস ছাড়া বহিরাগতদের ডমিসাইল না দেওয়া
- • তফসিলি উপজাতিদের কোটা ৪৫% থেকে বাড়িয়ে ৮৪%।
- • ১,৮০০ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
তবে মূল দাবিগুলো—পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুটি লোকসভা আসন, ভূমি ও কর্মসংস্থানে স্থানীয়দের নিশ্চয়তা—অপূরণ রয়ে গেছে।

ওয়াংচুক সতর্ক করেছিলেন, “আমাকে জেলে রাখলে পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হবে।”
তাঁর গ্রেপ্তারের পর LAB ও KDA কেন্দ্রের সঙ্গে ৬ অক্টোবরের বৈঠক বর্জন করে মৃতদের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
অবশেষে ২ অক্টোবর একটি ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের নির্দেশ আসে।
সীমান্ত রাজনীতি ও ভেতরের সংকট
লাদাখ ভারতের কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল সীমান্ত অঞ্চল—চীনের সঙ্গে ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর এখানকার নিরাপত্তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ সতর্ক করেছেন, “স্থানীয় নেতৃত্বকে দমন করলে সেই শূন্যস্থান অন্যরা কাজে লাগাতে পারে।”
তবুও উপরাজ্যপাল কবিন্দর গুপ্তা দাবি করেছেন, “বিদেশি শক্তির প্রভাব রয়েছে।”
লেহ অ্যাপেক্স বডি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
ফলে দিল্লির সঙ্গে লাদাখের সম্পর্ক এখন নতুন এক সংকটে—সমঝোতার পথ হয়তো এখনও সম্ভব, কিন্তু তার জন্য দরকার সংবেদনশীল, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
#লাদাখ #সোনম_ওয়াংচুক #রাজ্যের_দাবি #ভারত #ষষ্ঠ_তফসিল #সহিংসতা #রাজনীতি #হিমালয় #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















