ব্যঙ্গের জন্য নির্বাসিত কৌতুকশিল্পী
ভারতের পরিচিত স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান কুনাল কামরা এখন তার নিজ দেশেই একপ্রকার নির্বাসনে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে রসিকতা করা যেন আজ ধর্মবিরোধিতার সমান অপরাধ। একসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন একাধিক শো করা কামরা এখন ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে মঞ্চ থেকে দূরে। কারণ, তার কৌতুকে ক্ষুব্ধ হয়ে শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের উসকানিতে মুম্বাইয়ের এক ক্লাবে হামলা চালানো হয়—যেখানে তিনি আগে অনুষ্ঠান করেছিলেন।
স্বাধীন মতপ্রকাশে সংকোচ ও ভয়ের সংস্কৃতি
কামরার মতে, মোদি সরকারের দশ বছরে দেশে এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যেখানে ভিন্নমত প্রকাশ করা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাস্যরস, ব্যঙ্গ কিংবা রাজনৈতিক সমালোচনা—সবকিছুর ওপরই এখন নজরদারি ও মামলা। তিনি বলেন, “এখন পুলিশের এফআইআর বা আদালতের নোটিশ পাওয়া যেন সৌভাগ্যের বিষয়; এর চেয়ে ভয়াবহ কিছু ঘটার সম্ভাবনাও থাকে।”
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শাসক দলের সমর্থনে একপ্রকার সংগঠিত সেন্সরশিপ তৈরি হয়। সমালোচকদের বিরুদ্ধে মামলা, ট্যাক্স রেইড, এবং তদন্ত সংস্থার চাপ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। আর যারা সরকারের প্রশংসা করে, তাদের জন্য উন্মুক্ত থাকে ব্যবসা ও সম্পদের সুযোগ।
গণমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও নীরবতা
ভারতের অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেল এখন সরকারের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, মোদি সরকার প্রথমেই সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে আনে। যেসব ব্যবসায়ী সংবাদমাধ্যমের মালিক, তাদের ওপর কর হানা, বিজ্ঞাপন বন্ধ বা চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে অনেকেই দ্রুতই ‘লাইন মেনে’ চলে আসেন। যারা মানেননি, তাদের মিডিয়া হাউস কিনে নিয়েছেন সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা।
ফলে সমালোচনামূলক কণ্ঠগুলো হয় নীরব, নয়তো ইউটিউব বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রান্তে টিকে আছে। কামরার ভাষায়, “ভারতের শিল্পীরা সব সময়ই প্রতিষ্ঠানের সেবক ছিলেন। আগে তারা ম্যানেজারের ভূমিকায় ছিলেন, এখন ওয়েটারের।”
হামলা, মামলা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা
গত মার্চে কামরা ইউটিউবে একটি স্ট্যান্ডআপ শো প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিজেপির দলভাঙা কৌশলকে ব্যঙ্গ করেন। ওই শোতে তিনি নাম না করে মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্দেকে ‘গদ্দার’ বলে ইঙ্গিত দেন। এর পরপরই তার বিরুদ্ধে সহিংসতা ও হুমকি শুরু হয়। পরদিন একদল উগ্রপন্থী মুম্বাইয়ের হ্যাবিট্যাট ক্লাবে হামলা চালায় এবং স্থানটি বন্ধ করে দেয়।
এর পর থেকে কুনাল কামরার ওপর চলছে পুলিশি পাহারা। ২৪ ঘণ্টা অস্ত্রধারী প্রহরী পাহারা দেন তার পন্ডিচেরির বাড়িতে, যেখানে তিনি এখন থাকেন। তিনি সেখানে ছোট একটি রেকর্ডিং স্টুডিও ও ইউটিউব টিম নিয়ে ভিডিও ইন্টারভিউ ও ব্যাখ্যামূলক কনটেন্ট তৈরি করেন।
ইউটিউবেই নতুন মঞ্চ
কামরার জীবনের কেন্দ্র এখন তার ইউটিউব চ্যানেল। তিনি বলেন, “বড় মঞ্চ বন্ধ হলে ছোট মঞ্চে গেছি, সেটাও বন্ধ হলে ইউটিউবে কাজ করছি। ইউটিউব বন্ধ হয়ে গেলে অন্য রাস্তা বের করব।”
তার ভিডিওগুলোতে থাকছে সমাজ, রাজনীতি ও নাগরিক অধিকার নিয়ে বিশ্লেষণ—কখনও মেঘফাটা বৃষ্টি, কখনও গিগ কর্মীদের অধিকার নিয়ে আলোচনা। ব্যঙ্গ আর প্রতিবাদের ভাষা হারালেও তিনি থেমে যাননি।
ভারতীয় বিনোদন জগতে নীরবতা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কৌতুকশিল্পীদের দ্বন্দ্বে যেখানে জনসমর্থন দেখা যায়, ভারতে তার উল্টো চিত্র। কামরার ক্ষোভ এখানেই—“ভারতের বড় বড় তারকারা এখন কেবল জন্মদিনের শুভেচ্ছা বা সরকারি কর্মসূচির প্রশংসায় ব্যস্ত। নাগরিক হিসেবে তাদেরও দায়িত্ব আছে, বিশেষ করে যখন মাইক্রোফোন হাতে থাকে।”
গণতন্ত্রের সংকোচন
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্বকে সতর্কবার্তা দিচ্ছে—গণতন্ত্রের ভিত কীভাবে ধীরে ধীরে নড়বড়ে হয়। মোদি সরকারের অধীনে সমালোচনা ও ব্যঙ্গরস যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কুনাল কামরার অভিজ্ঞতা তারই প্রতিফলন।
তিনি একা নন; অসংখ্য সাংবাদিক, শিল্পী ও লেখকও এখন নীরবতার সীমায় দাঁড়িয়ে। স্বাধীন মতপ্রকাশ যেখানে অপরাধে পরিণত, সেখানে হাসিরও আছে রাজনৈতিক মূল্য।
#ভারত #কুনাল_কামরা #মোদি #স্বাধীন_মতপ্রকাশ #স্ট্যান্ডআপ_কমেডি #নীরবতা #সারাক্ষণরিপোর্ট