উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার সম্ভাবনা
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনায় যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি যোগাযোগ হতে পারে—এমনই ইঙ্গিত পেয়েছে নয়াদিল্লি। এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক বার্তায় বলা হয়েছে, এই উচ্চ পর্যায়ের ‘এনগেজমেন্ট’ই হতে পারে আলোচনাকে শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর উপায়।
তবে এই সাক্ষাৎ আয়োজন করা সহজ নয়। কারণ ট্রাম্পের কূটনৈতিক ধরন প্রথাগত নয়, বরং কিছুটা অনিশ্চিত ও নাটকীয়। নয়াদিল্লি আশা করছে, নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সের্জিও গোর এই প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখতে পারেন। কর্মকর্তার ভাষায়, “ট্রাম্প চান মোদি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন—কিন্তু ভারতের কূটনৈতিক প্রথা অনুযায়ী সাধারণত চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পরই এমন বৈঠক হয়।”
আসিয়ান সম্মেলন ঘিরে আশাবাদ
আগামী ২৬–২৮ অক্টোবর কুয়ালালামপুরে আসিয়ান ও পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। যদি মোদি ও ট্রাম্প উভয়েই সেখানে যোগ দেন, তবে পরোক্ষ বৈঠকের একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে মোদির সফর এখনও নিশ্চিত নয়। একজন কর্মকর্তা বলেন, “এখনও আলোচনা চলছে, পরবর্তী দিনগুলো কীভাবে এগোয়, তা বলা যাচ্ছে না।”
গত কয়েক মাস ধরে চলমান আলোচনায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঘর্ষণ দেখা দিয়েছে—রাশিয়া–ভারত বাণিজ্য, মার্কিন পক্ষের শুল্ক নিয়ে সমালোচনা, এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের ভারতীয় বাণিজ্যনীতি নিয়ে তীব্র মন্তব্য। ফলে নয়াদিল্লি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এক কর্মকর্তা জানান, “চুক্তি সই হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ কোনোভাবেই সম্ভব নয়, কারণ ট্রাম্প প্রায়শই প্রকাশ্যে কূটনীতি চালান, যা ভারতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক হিসাব
দেশীয় রাজনীতির বিষয়ও এই আলোচনায় প্রভাব ফেলছে। এক সরকারি সূত্র বলেন, “মোদি ও ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা সবসময় তাকে ‘জয়ী নেতা’ হিসেবে উপস্থাপন করে। তাই এমন কোনো বৈঠক যদি ব্যর্থ হয়, তা রাজনৈতিকভাবে নেতিবাচক হতে পারে।”
ভারত ফেব্রুয়ারি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির আলোচনা শুরু করেছিল। সাত মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কয়েকটি অমীমাংসিত বিষয় চুক্তি চূড়ান্ত করতে বিলম্ব ঘটাচ্ছে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, “এসব জটিলতা অতিক্রম করা সম্ভব।”
মূল অমীমাংসিত বিষয়গুলো
মূল সমস্যা তিনটি—
১. ট্রাম্পের দাবি, তিনি ‘অপারেশন ইনডোর’ চলাকালে ভারত–পাকিস্তান সংঘাত শেষ করেছিলেন, যা ভারত অস্বীকার করছে।
২. ভারতের রাশিয়া থেকে তেল আমদানি, যা যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইউক্রেনে যুদ্ধ অর্থায়নে ভূমিকা রাখছে।
৩. ভারতের কৃষিপণ্যের বাজার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত না করা।
জ্বালানি বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা
তবু নয়াদিল্লি কিছু ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখাচ্ছে। নিউ ইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাতের পর বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানান, ভারত ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্য আরও বিস্তৃত করতে চায়। তিনি বলেন, “আমরা প্রাকৃতিক মিত্র, তাই জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।”
ভারত পারমাণবিক জ্বালানিতেও সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে উন্নয়নাধীন ছোট মডুলার রিঅ্যাক্টর নিয়ে।
রুশ তেল নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন
প্রথমে রুশ তেল আমদানি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেও পরবর্তীতে তারা ক্রয়ের উৎস বৈচিত্র্য করেছে। এই পরিবর্তনকে ওয়াশিংটন ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে।
সম্পর্কের উষ্ণতা ফেরার ইঙ্গিত
‘অপারেশন ইনডোর’-এর পর থেকে মোদি–ট্রাম্প সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে পড়লেও সেপ্টেম্বর থেকে আবার উষ্ণতার আভাস দেখা গেছে। মোদির জন্মদিন উপলক্ষে ট্রাম্প শুভেচ্ছা জানান, আর মোদি প্রকাশ্যে ট্রাম্পের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন ও তার গাজা শান্তি পরিকল্পনাকে সমর্থন জানান। ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নিয়েও মোদি ট্রাম্পকে সমর্থন জানান।
ব্যক্তিগত ও কূটনৈতিক সম্পর্কের বৈপরীত্য
এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, “ট্রাম্প দ্ব্যর্থহীন ব্যক্তি—তিনি যা বলেন, তাই বোঝান। ভারতের শুল্ক বা রুশ তেল নিয়ে তার ক্ষোভ যেমন সত্য, তেমনি মোদিকে বন্ধু বলা তার আন্তরিক অনুভূতিও সত্য।”
কর্মকর্তার মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য—পেশাগত ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক আলাদা রাখা হয়। তবে ভারতের কাছে এই পার্থক্য বোঝা সবসময় সহজ নয়।
সব মিলিয়ে, ট্রাম্প প্রশাসনের অপ্রত্যাশিত কূটনৈতিক ধারা ও ভারতের সতর্ক অবস্থানের মধ্যেও নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। যদি মোদি–ট্রাম্প সাক্ষাৎ সত্যিই হয়, তবে তা শুধু দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক নয়, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার কূটনৈতিক সমীকরণেও নতুন গতি আনতে পারে।