ভারতের নিরাপত্তা আশঙ্কা দূর করতে মিয়ানমার জানিয়েছে—বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত কোকো দ্বীপপুঞ্জে কোনো চীনা উপস্থিতি নেই। তবে নয়াদিল্লি যে দ্বীপপুঞ্জে নৌবাহিনীর প্রতিনিধিদল পাঠানোর অনুরোধ করেছিল, সে বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়নি মিয়ানমারের সেনাশাসিত সরকার।
দ্বীপের কৌশলগত অবস্থান ও ভারতের উদ্বেগ
ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে কোকো দ্বীপের দূরত্ব ১০০ মাইলেরও কম। এ অঞ্চলে চীনা সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভারত উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র (বালেশ্বর টেস্ট রেঞ্জ) এবং ভিসাখাপত্তনমের কাছাকাছি রামবিল্লি নৌঘাঁটি থেকে পারমাণবিক সাবমেরিনের গতিবিধি চীন নজরদারি করতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই নয়াদিল্লির উদ্বেগ বেড়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, চীন কোকো দ্বীপগুলোকে ব্যবহার করছে ভারতের কৌশলগত সক্ষমতা ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পরিসীমা বিশ্লেষণের জন্য। স্যাটেলাইট ও বিমান নজরদারির মাধ্যমে চীনের এই কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা সংলাপ ও চীনা উপস্থিতি অস্বীকার
গত সেপ্টেম্বর (২৫–২৭ তারিখ) মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশ কুমার সিং দ্বিতীয় বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপে অংশ নেন। তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রধান মেজর জেনারেল কিয়াও কো হ্তিকের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সে সময় মিয়ানমারের জান্তা সরকার ভারতের উদ্বেগ দূর করতে স্পষ্টভাবে জানায়, কোকো দ্বীপে “একজনও চীনা নাগরিক নেই।” তবে ভারতের নৌবাহিনী যে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শনের অনুরোধ জানিয়েছিল, সে বিষয়ে এখনও কোনো অনুমোদন বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
স্যাটেলাইট চিত্রে পরিকাঠামো সম্প্রসারণ
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সংগৃহীত উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে, কোকো দ্বীপে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন চলছে। দ্বীপের রানওয়ে সম্প্রসারিত হয়ে এখন ২,৩০০ মিটার পর্যন্ত হয়েছে, যা বড় আকারের পরিবহন বিমানের অবতরণে সক্ষম। এছাড়া প্রায় ১,৫০০ সামরিক সদস্যের থাকার মতো ব্যারাক ও শেড নির্মিত হয়েছে। পাশাপাশি কোকো দ্বীপ ও পাশের জেরি দ্বীপকে সংযুক্ত করতে একটি বাঁধ নির্মাণের কাজও চলছে।
এই উন্নয়ন কার্যক্রম ইঙ্গিত দেয়, দ্বীপপুঞ্জে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে—যদিও মিয়ানমার সরকার দাবি করছে, সেখানে কোনো চীনা সৈন্য নেই।
উত্তর মিয়ানমারে চীনের প্রভাব বলয়
মিয়ানমার সরকার বলছে, তাদের দেশে কোনো চীনা সৈন্য নেই। কিন্তু বাস্তবে নেপিদোর নিয়ন্ত্রণ চিনদউইন নদীর উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে খুবই সীমিত। উত্তর মিয়ানমারে চীনঘনিষ্ঠ বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও অস্ত্রধারী মাদকচক্রগুলো শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। এসব গোষ্ঠীর প্রভাব ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশের বিজয়নগর এলাকা ও মণিপুর সীমান্ত অঞ্চলে।
বিশ্বাসের ঘাটতি ও কৌশলগত প্রতিযোগিতা
মিয়ানমার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের উপস্থিতি অস্বীকার করলেও ভারতের উদ্বেগ পুরোপুরি দূর হয়নি। কারণ, অঞ্চলের ভূরাজনীতি এখন মূলত চীন ও ভারতের কৌশলগত প্রতিযোগিতায় আবদ্ধ।
বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান অঞ্চলে চীনের নজরদারি ঘাঁটির আশঙ্কা ভারতের নিরাপত্তা নীতিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলছে। ফলে কোকো দ্বীপপুঞ্জ এখন কেবল একটি ছোট দ্বীপ নয়, বরং ভারত–চীন প্রভাব-যুদ্ধের নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
#কোকোদ্বীপপুঞ্জ #মিয়ানমারভারতসম্পর্ক #চীনভারতপ্রতিদ্বন্দ্বিতা #বঙ্গোপসাগরনজরদারি #সারাক্ষণরিপোর্ট