রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেমে সম্মান, কিন্তু কেরের না
৯০ বছর বয়সী কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ক্যারল কে’কে (Carol Kaye) সম্প্রতি রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেমে “সঙ্গীত উৎকর্ষ” বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই স্বীকৃতি তিনি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। নিজের বক্তব্যে তিনি বলেন, “আমি রকার নই, আমি জ্যাজ সংগীতশিল্পী। আমি একক শিল্পীও নই—আমি ছিলাম স্টুডিও টিমের অংশ।”
কের এই সিদ্ধান্তে তার ভক্ত ও সহকর্মীরা বিস্মিত হয়েছেন। তবে তিনি সবসময়ই নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন—“আমি অন্যদের খুশি করার জন্য কিছু করি না,” বলেছিলেন তিনি দৃঢ় কণ্ঠে।
জ্যাজ গিটার থেকে বিশ্বখ্যাত বেস বাজিয়ে
ক্যারল কের ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেসের সংগীত জগতে ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম। জ্যাজ গিটারিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরে পপ সংগীত ও ইলেকট্রিক বেস বাজনায় নিজের জায়গা তৈরি করেন তিনি।
তিনি বাজিয়েছেন হাজারো জনপ্রিয় গানে—সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেল, সনি অ্যান্ড শেয়ার, বারবারা স্ট্রেইস্যান্ড, জো ককারসহ বহু কিংবদন্তি শিল্পীর সঙ্গে। হলিউডেও তার দারুণ চাহিদা ছিল—‘মিশন ইম্পসিবল’, ‘দ্য ব্র্যাডি বান্চ’ ও ‘ইন দ্য হিট অব দ্য নাইট’-এর মতো চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজে তার বাজনা শোনা যায়।
পল ম্যাককার্টনির বিস্ময়
ব্রিটিশ কিংবদন্তি পল ম্যাককার্টনি যখন প্রথমবার দ্য বিচ বয়েজের বিখ্যাত অ্যালবাম Pet Sounds শোনেন, তখন বেস বাজনায় মুগ্ধ হন। পরে ক্রেডিট তালিকায় দেখে অবাক হয়ে জানতে পারেন, সেই বাজিয়েছেন ব্রায়ান উইলসন নন—বরং এক নারী, ক্যারল কে। ম্যাককার্টনি বলেন, “আমি খুঁজে দেখতে শুরু করি, তিনি আর কোন গানগুলোতে বাজিয়েছেন—আর দেখি, প্রায় সব জায়গাতেই তিনি আছেন!”
স্টুডিওতে একমাত্র নারী
পুরুষে ভরা স্টুডিওতে কের ছিলেন একমাত্র নারী। তবু তিনি কখনও পিছিয়ে যাননি। “যদি কেউ আমাকে অপমান করত, আমি তীব্রভাবে পাল্টা দিতাম। আমি শিখে গিয়েছিলাম তাদের থেকেও কঠিনভাবে কথা বলতে,” তিনি হাসতে হাসতে বলেন।
এক সেশনে যখন বেস বাজিয়ে অনুপস্থিত ছিল, তখন প্রযোজকের অনুরোধে কের গিটার থেকে বেসে চলে আসেন—সেই মুহূর্ত থেকেই বদলে যায় তার জীবন। তার অনন্য বাজানোর ধরন, পিক ব্যবহার ও রিদমিক সাউন্ড স্টুডিওর প্রযোজকদের মুগ্ধ করে।
হলিউড, বই ও শিক্ষাদান
১৯৭০-এর দশকে তিনি ব্যস্ত পপ ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে যান এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের কাজের দিকে মনোনিবেশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইলেকট্রিক বেস শেখানোর প্রথম দিকের বইগুলো লেখেন, যা আজও বহু সংগীতশিল্পীর জন্য আদর্শ পাঠ্য। কিংবদন্তি প্রযোজক কুইন্সি জোন্স একবার বলেছিলেন, “কের যা পারে, তা অনেক পুরুষ শিল্পীও পারে না।”
কঠিন শৈশব থেকে সংগীতের আলো
ওয়াশিংটনের এভারেটে জন্ম নেওয়া ক্যারল স্মিথ (পরে কের) ছোটবেলা থেকেই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হন। পিতার নেশা ও পরিবারের অর্থকষ্টে ৯ বছর বয়সে ঘর পরিষ্কারের কাজ করতেন তিনি। পরে তার মা কষ্ট করে মাত্র ১০ ডলার জোগাড় করে তাকে একটি গিটার কিনে দেন। সেখান থেকেই শুরু।
১৪ বছর বয়সে বিখ্যাত শিক্ষক হোরেস হ্যাটচেটের অধীনে পড়াশোনা শুরু করেন, যিনি তার প্রতিভা চিনতে পারেন এবং তাকে নাইটক্লাবে বাজানোর সুযোগ করে দেন। কৈশোরে মা হওয়ার পরেও কের সংগীত ছাড়েননি—বরং সেটাকেই জীবনের প্রধান ভরসা বানান।
কিংবদন্তি হয়ে ওঠা
সনি অ্যান্ড শেয়ারের “দ্য বিট গোজ অন” বা গ্লেন ক্যাম্পবেলের “উইচিটা লাইনম্যান”-এর মতো গানে তার তৈরি বেসলাইন আজও কিংবদন্তি। ১৯৬০-এর দশকে তিনি সপ্তাহে ডজনখানেক সেশনে বাজাতেন—তখন তার বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৭৫ হাজার ডলার, যা আজকের হিসেবে ছয় লাখ ডলারেরও বেশি।
ব্রায়ান উইলসন একবার বলেছিলেন, “সে বিশ্বের সেরা বেস বাজিয়ে।” আর ম্যাককার্টনি বলেন, “ক্যারল আর জেমস জেমারসন আমাকে শেখালেন, বেস বাজনাও সুরের অংশ হতে পারে।”
নারী সংগীতশিল্পীদের অনুপ্রেরণা
১৯৯০-এর দশকে ইন্টারনেট ও সংগীত-নস্টালজিয়ার যুগে কেরের কাজ নতুনভাবে মূল্যায়ন পায়। গো-গোজ ব্যান্ডের ক্যাথি ভ্যালেন্টাইন বলেন, “তিনি এমন এক সময় সংগীত করেছেন, যখন অধিকাংশ নারী ঘরে গৃহিণী ছিলেন। তার গল্প আমার মতো অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে।”
কেরকে বলা হয় সেশনের ‘সুসান বি. অ্যান্থনি’—পুরুষশাসিত স্টুডিওতে তিনি একা পথ খুলে দিয়েছিলেন অসংখ্য নারীর জন্য। তার একটি বিখ্যাত উক্তি—“নোটের লিঙ্গ নেই; সুরটা হয় সঠিক, না হয় ভুল।”
নিজের শর্তে বেঁচে থাকা
কের মনে করেন, রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেমে নাম ওঠা তার জীবনকে নতুন করে মূল্যায়ন করবে না। “আমার কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল বাজানো—সেই অনুভূতিটাই শ্রেষ্ঠ,” তিনি বলেন। “সংগীত এমন এক শক্তি দেয়, যা কোনো নেশা বা সম্পদ দিতে পারে না।”
ক্যারল_কে, রক_অ্যান্ড_রোল_হল_অফ_ফেম, নারী_সংগীতশিল্পী, পল_ম্যাককার্টনি, জ্যাজ, পপ_সংগীত, সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 






















