০৫:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে স্থগিত পাঁচ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন গাজীপুরে অভিযান: সাবেক ছাত্রদল নেতা এনামুলসহ ৭ জন অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতীফ সিদ্দিকীর জামিন মঞ্জুর দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি: শক্তির মাধ্যমে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে নির্বাচনের আগের পরিবেশ এখনো নাজুক: আইআরআই টাইফুন কালমায়গির তাণ্ডবে ফিলিপাইনে ১১৪ জনের মৃত্যু, ঝড়টি শক্তি সঞ্চয় করে ভিয়েতনামের দিকে অগ্রসর মৃত্যুর হিসাব এখনো চলছে: টাইফুন ‘টিনো’-র তাণ্ডব পেঁয়াজের দাম: দশ দিনেই দ্বিগুণ বাড়ার কারণ কী? আলাস্কায় টাইফুনে বিধ্বস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষায় মরিয়া চেষ্টা এআই যুগে নতুন প্রেমের খোঁজ: ডেটিং অ্যাপের রূপান্তর

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৩৮)

রাজসাহীর রাজা ও জমিদার

মহাভারতীয় বিরাট নগরের ভগ্নাবশেষ, সেনাপতি কীচক বধের নর্তনাগার, অজ্ঞাতবাস সময় পাণ্ডবগণ স্থাপিত দেবমন্দির, মহাভারতীয় “সমী” বৃক্ষের স্থান নয়নপথে পতিত হইবানার সহসা এই প্রশ্নের উদয় হয়, “যে মৎস্য দেশান্তর্গত বারেন্দ্রভূমি রাজসাহী প্রদেশ পাণ্ডবগণের বাসে পুণ্য ক্ষেত্র বলিয়া অদ্যাপিও কীর্তিত হইতেছে, এবং যে প্রদেশের সীমা এককালে ভাগলপুর হইতে ঢাকা পর্যন্ত এবং রঙ্গুর (ঘোড়াঘাট) হইতে বীরভূম ও বীরকিটি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; সেই বিস্তৃত রাজসাহীর অতীত বৃত্তান্ত স্মৃতি পথে উদিত হইলে আমাদের হৃদয় এক অভিনব আনন্দে পরিপূরিত হয় কেন?” এ প্রশ্নের উত্তর- দীর্ঘকাল বিদেশে বাস করার পর স্বদেশ প্রতিগমনে স্বদেশের অতীত বৃত্তান্ত শ্রবণে বা কীর্তনে আমরা যেরূপ আনন্দ অনুভব করি, সেইরূপ রাজসাহীর রাজা ও জমিদারগণের অতীত বৃত্তান্ত কীর্তন করিব বলিয়া আমাদের আনন্দের সীমা রহিল না। প্রাচীন রাজসাহী- প্রাতঃস্মরণীয় লক্ষ্মীস্বরূপা মহারাণী ভবাণীর বাসভবন; যোগী রাজা রামকৃষ্ণের যোগ স্থান; বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের কৌলীন্য প্রথানুযায়ী প্রধান সমাজ ভূমি; নানাবিধ শস্য ক্ষেত্র ও “উৎকৃষ্ট রেশম” উৎপন্ন স্থান- সে পূর্বতন রাজসাহীর কীর্তিকলাপ কীর্তন করা স্বদেশহিতৈষিতা প্রবৃত্তিতে মানবকে চালিত করিয়া থাকে। কিন্তু হায়। দুঃখের বিষয় যে রাজসাহীর জমিদারগণের ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত লুক্কায়িতভাবে আছে অথবা কোন স্থানে অতীত বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করিবার প্রণালী অজ্ঞাতভাব ধারণ করিয়াছে। এরূপ স্থলে প্রকৃত ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত প্রকাশ করা অত্যন্ত কঠিন। লুক্কায়িত ধন কতক পরিমাণে প্রকাশিত হইলে রাজসাহীবাসীরা অবশ্যই আনন্দ অনুভব করিবেন।

 

রাজসাহী রাজা ও উপাধি বিহীন সম্ভ্রান্ত জমিদারগণের সমাজক্ষেত্র। কাহার রাজা উপাধি আছে, কাহার উপাধি নাই। কিন্তু সম্মানে কি রাজদ্বারে, কি জাতীয় সমাজে অনেকেই উচ্চ আসন গ্রহণ করিয়া থাকেন। ইহাদের পূর্বপুরুষদিগের কীর্তিকলাপ এরূপ ছিল যে রাজসাহীতে তাহাদের নাম যশ সর্বজন পরিচিত ছিল। কালের গতি বিচিত্র। কালেই সকল ধ্বংস হয়। অনেক প্রাচীন বংশ ধ্বংস হইয়াছে এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে ইতিবৃত্তিও লোপ হইয়াছে। কেবলমাত্র লোক প্রমুখাৎ বংশের নাম কীর্তিত হইতেছে।

 

রাজসাহীতে তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণের বংশ এবং সাঁতুলের রাজবংশ আদিও প্রসিদ্ধ ছিল। বঙ্গের দ্বাদশ ভৌমিকের অন্তর্গত এই দুইটি “ভৌমিক”-তাহিরপুর ও সাঁতুল। এই প্রাচীন বংশই ধ্বংস হইয়াছে।

 

নাটোরের রাজবংশের অভ্যুদয়ের পূর্বে পুঠিয়া রাজবংশের উৎপত্তি ইতিহাসে কীর্তিত হইয়াছে। বারবকপুর পরগণার রাজা বা জমিদারও অনেক পুরাতন ঘর বলিয়া প্রসিদ্ধ এবং তাহিরপুর এবং সাঁতুল রাজবংশের অভ্যুদয়েরও পূর্বে দুবলহাটি রাজবংশের স্থিতি বলিয়া কথিত আছে। কিন্তু দুবলহাটি রাজ্য একটি ক্ষুদ্র ও অপরিচিত জমিদারি এবং জমিদার নিম্ন জাতীয় শূদ্র বলিয়া তাহার নাম লুক্কায়িত ছিল। নাটোরের রাজবংশ এত প্রসিদ্ধ যে সমগ্র ভারতবর্ষে ইহার খ্যাতি ও নাম অদ্যাপি বর্ণিত হইতেছে। সামান্য অবস্থা হইতে একটি অতি বিস্তৃত রাজোর অধীশ্বর হইয়া মানব-মণ্ডলী শাসনাধীন হইয়াছিল তাহার নাটোর বংশই জাজ্বল্য প্রমাণ।

রঘুননন্দন এই নাটোর বংশের ভীতি স্থাপন করেন। ইতা কদিত হয় যে কোন ব্যক্তি অল্প সময় নাটোর বংশের রাজত্ব সময় তাহিরপুর, পঠিয়া ও সুবলহাটি রাজবংশ ব্যতীত প্রায় সমুদয় রাজ মধ্যে অতিশয় ঐশ্বর্যবান হইলে লোকে তাহাকে বলিয়া থাকে এ বাক্তির ‘রজনী বড়। জমিদার নাটোর রাজের অধীন থাকিয়া পরে ক্রমে স্বাধীন ভূমাধিকারী হইয়া উঠিয়াতেন। আত্রাই ও করতোয়া নদীর মিলন স্থানের নিকট সাঁতুল রাজার প্রাচীন রাজলানীর অরাবণের ভটিগোচর হয়। ইহার নিকটে সাঁততুলের বিল নামে একটি বিস্তৃত জলাশয় বিদ্যমান আছে। সাঁতুলের বিল প্রসিদ্ধ বিলচলনের সহিত সংযোজিত। পূর্বে বিলচলনের পথ ব্যতীত উত্তরবঙ্গে বাণিজ্যতরী গমনাগমনের অন্যপথ ছিল না। একজন রাহ্মণ জমিদার সাঁতুলের রাজা ছিলেন। রাজা গণেশ বা কংসের সময় সাঁতুল রাজ্যের সৃষ্টি হয়। তপ্নে ভাদুড়ি (ভাতুড়িয়া) ও তদন্তরি ২৪১৯৭ টাকার বার্ষিক রাজস্বের ১৩ পরগণা তাহার অধিকৃত ছিল। আত্রাই নদীর উভয় পার্শ্বে ভাতডিয়া প্রদেশ। উড়িষ্যা সুবে বাংলার অধীন। উড়িষ্যা লইয়া এই সুবে বাংলা ২৪ সরকারে বিভক্ত। এই ২৪ সরকারের, সরকার মাহমুদাবাদের অথবা সরকার বাজুয়ার অদীন সাঁতুল রাজ্য। এই রাজ্যের বার্ষিক রাজস্ব আইন আকবরীতে ১৯০৭২৭ দাম লিখিত আছে। যে সময় আরঙ্গজেবের পৌত্র আজিমওযমান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসনকর্তা, সেই সময় সীতানাল সাঁতলের রাজা। তখন তাহার বয়স প্রায় ৫০/৬০ বৎসর। সুতরাং বিষয় কার্মের সমস্ত ভার তাহার কনিষ্ঠ রামেশ্বরের প্রতি অর্পিত হয়। রামেশ্বর অতি বলবান এবং তাহার প্রতাপে উত্তর বঙ্গ কম্পিত হইয়াছিল। রামেশ্বর অতি চতুর ছিলেন। রামেশ্বর জ্যেষ্ঠের অনুগত ছিলেন এবং রাজা সীতানাথও অতিসুধীর ও ধার্মিক এবং কনিষ্ঠের প্রতি তাহার অসাধারণ স্নেহ ও বিশ্বাসে। সীতানাথ দুই বিবাহ করেন। কিন্তু তাহার পুত্র ছিল না। কেবল কনিষ্ঠ রামেশ্বরের এক পুত্র। পুত্রের নাম রামকৃষ্ণ। রাণী সর্বাণীই এই রামকৃষ্ণের পত্নী। সীতানাথের শেষাবস্থায় তাহার কনিষ্ঠ রামেশ্বর নিতান্ত অবিশ্বাসের কার্য করিয়া তাহার জ্যেষ্ঠের হৃদয়কে দগ্ধ করেন। সেই শোক ও দুঃখে রাজা সীতানাথ পরলোক গমন করেন। রামেশ্বরের অধর্মই সাঁতুল রাজ্যের ধ্বংসের মূল কারণ: এবং রামেশ্বরের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসই রাজা সীতানাথের সর্বনাশের হেতু হইয়াছিল।

সাঁতুল ভৌমিক প্রাচীন বংশ এককালে লোপ পাইয়াছে। এই বংশের শেষ রাণী সর্বাণীর মৃত্যুর পর তাহার ভাতুড়িয়া প্রভৃতি বিস্তৃত রাজ্য নাটোর বংশের রঘুনন্দনের হস্তগত হইয়াছিল। “বাংলা ১১১৭ সালে (১৭১০ খ্রিস্টাব্দে) আধুনিক রাজসাহী জেলার অন্যতম প্রধান পরগণা ভাতুড়িয়া ব্রাহ্মণ জমিদার (সান্তোল রাজ) রামকৃষ্ণের পত্নী সর্বাণী দেবীর মৃত্যু হইলে তাহাদের এক মাত্র উত্তরাধিকারী কৃষ্ণরামের ভ্রাতুষ্পুত্র বলরাম জন্মান্ধ ও বধির উল্লেখে জমিদারি কার্য পরিচালনে অসমর্থ বলিয়া ঐ বিস্তীর্ণ জমিদারির কার্যভার তৎকালীন একমাত্র সমর্থ রঘুনন্দনের হস্তে পড়িল। সাঁতুলের রাণী সর্বাণী করতোয়া নদীতটে যে মহাপীঠের আবিষ্কার করেন তাহা দর্শন করিবার জন্য অনেক যাত্রী যাইত। রাণী সর্বাণী কৃত দেবমন্দির আদির জীর্ণ সংস্কার রাণীভবানী করিয়া দেন। ইহাও কথিত আছে যে সাঁতুলের রাজবংশ “পঞ্চপাতকী” বলিয়া প্রসিদ্ধ। কেহ কেহ ইহাও বলিয়া থাকেন যে এই মহাপাপ আশ্রয় করার পর হইতে সাঁতুল রাজবংশ ধ্বংসের সূত্রপাত হয়।

‘বারাহী’, এখন বারীণই নামে প্রসিদ্ধ। এই বারাহী নদীর পূর্বতীরে, রামরামার গ্রামে তাহিরপুরের বিখ্যাত ভৌমিক বংশের রাজধানী ছিল। বারাহী এখন নিতান্ত সঙ্কীর্ণ হইয়া গিয়াছে। রামরামার পশ্চিমে বারাহীর অপর পারে তাহেরপুরে বর্তমান রাজবাটি। সুসঙ্গ রাজবংশের পূর্বপুরুষ মধ্যে বুদ্ধিমন্ত হাজরা নামে একজন বলবান ও সাহসী পুরুষ জন্মগ্রহণ করেন। তাহার বল, বিক্রম ও কৌশলের পরিচয় পাইয়া দিল্লির সম্রাট তাহাকে বঙ্গদেশের পূর্ব দ্বারের জমাদার নিযুক্ত করেন এবং খাঁ ও সিংহ উপাধি দেন। পূর্ব দ্বার-রক্ষা জন্য তাহাকে সৈন্য সামন্ত রাখিতে হইত। সেই ব্যয় নির্বাহ জন্য সম্রাট আসাম ও বাংলার নিকটবর্তী স্থান সুসঙ্গ রাজাকে দেন। এই বুদ্ধিমন্ত খাঁর সময় তাহিরপুরে বিজয় লস্কর’ নামে একজন বীরপুরুষ বর্তমান ছিলেন। ইনি বঙ্গের পশ্চিমদ্বারের জমাদার। সুসঙ্গরাজ পূর্বদ্বার রক্ষক এবং তাহিরপুর রাজ পশ্চিমদ্বার রক্ষক বলিয়া সুসঙ্গ রাজ্য “উদয়াচল” এবং তাহিরপুর রাজ্য “অস্তাচল” নাম ধারণ করে। এই পশ্চিম দ্বার রক্ষার জন্য বিজয় লস্করকে দিল্লির সম্রাট ২২ পরগণা এবং সিংহ উপাধি প্রদান করেন। ইহা দ্বারা সৈন্যগণ প্রতিপালিত হইত। রাজবাটি রামরামায় ছিল এবং সেই স্থানে সৈন্য সামন্ত সহিত গড় আদি ছিল। এই বিজয় সিংহের পুত্র উদয়নারায়ণ বারেন্দ্র কুলীন ব্রাহ্মণগণ মধ্যে নিরাবিল পটির প্রথম সৃষ্টিকর্তা। যে সময় রূপ গোস্বামী গৌড়ের বাদসাহর প্রধান মন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় বাদসাহ সমস্ত রাজ্য উদয়নারায়ণের নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়া কেবল তাহিরপুর পরগণা মাত্র প্রদান করিলেন। সরকার বারবকাবাদের অধীন তাহিরপুর। এই তাহিরপুরের ৫০৫৮২৫ দাম বার্ষিক রাজস্ব ছিল। এই উদয়নারায়ণের পৌত্রই প্রসিদ্ধ রাজা কংসনারায়ণ নান্নাসী গ্রামী (নন্দনবাসী)। পুরুষোত্তম বেদান্তীর বংশে রাজা কংসনারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন। ইনি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। ইনি নন্দনীবাসী, সিদ্ধ শ্রোত্রিয়। কুলীনগণের আশ্রয়দাতা বলিয়া বারেন্দ্র সমাজে পদ গৌরবে কেহই ইহার সমকক্ষ ছিলেন না। কুলশাস্ত্র-বিশারদ উদয়নাচার্য এই নিয়ম করেন যে কুলীন কন্যা শ্রোত্রিয়ে প্রদান রহিত হইবে এবং কুলীনদিগের বিবাহ কুশবারি সংযুক্ত প্রতিজ্ঞা না করিয়া কেবল বাগদানে সম্পন্ন হইবে না। আবার তাহার প্রথম পক্ষীয় বণিতার ছয় পুত্রের সহিত একত্রে শয়নে ও ভোজনে কুলীনের কুলপাত হইতে লাগিল। এই ঘটনা হইতে অনেক কুলীনের কুলপাত হইতে লাগিল। কুলীনগণ ঐ ছয় ভ্রাতার ব্যবহারকে “কাচ” (ছল) বলিয়া স্থির করিলেন। এই “কাচ” হইতে “কাপ” শব্দ প্রসিদ্ধ হইল। উদয়নাচার্যের নিয়মে কুলীন বংশ লোপ হইবার আকার দেখিয়া রাজা কংসনারায়ণ বহুব্যয়ে সমস্ত কুলীন ও কাপকে একত্রিত করিয়া, সেই নিয়ম প্রচলিত করেন যে কাপ কুলীনে কন্যা আদানপ্রদান, কি কুশবারি সংযুক্ত বাগদান, প্রতিজ্ঞা ভিন্ন কুলীনের কুলপাত হইবে না। আবার কাপ দূষিত শ্রোত্রিয়ের কন্যা গ্রহণ করিলে সেই শ্রোত্রিয় উৎকর্ষ লাভ করিবেন। ইহাও বিধি হইল যে কাপ ও কুলীন শ্রোত্রিয়ের কন্যা গ্রহণ করিতে পারিবেন। এই নিয়মে কাপ কুলীনে আহার ব্যবহার প্রচলিত হইল এবং তাহার নিজ বংশের কন্যা কাপে প্রদান করিয়া তিনি সকলের নিকট অতি প্রশংসনীয় ও বারেন্দ্র সমাজে অতি প্রসিদ্ধ হন। রাজা কংসনারায়ণ বারেন্দ্রকুলের মূলাধার ছিলেন। রাজা কংসনারায়ণের প্রপৌত্র “রাজা লক্ষ্মীনারায়ণের কন্যার সহিত নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দনের জ্যেষ্ঠ সহোদর মহারাজা রামজীবনের ঔরস পুত্র রাজকুমার কালিকাপ্রসাদের বিবাহ হয়। কালিকাপ্রসাদের নাম কালু কোঙর বলিয়া ইতিহাসে লিখিত।” তাহিরপুর পরগণার দশ আনা অংশ রাজা কংসনারায়ণের বংশের পরিচয় স্বরূপ। এই বংশের শেষ রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ রায় ছিল। তাহার পুত্রসন্তান ছিল না। তাহার একমাত্র অবিবাহিতা কন্যা উমাদেবীকে রাখিয়া তিনি পরলোকগমন করেন। আনন্দীরাম রায়ের সহিত তাহার বিবাহ হয়। আনন্দীরাম রায়ের মৃত্যুর পর তাহার ভ্রাতা বিনোদরাম রায় ঐ দশ আনা অংশের উত্তরাধিকারী হইলেন। বিনোদরাম রায় অতিশয় বুদ্ধিমান ও চতুর পুরুষ ছিলেন। এই বিনোদরাম রায় বর্তমান তাহিরপুর রাজবংশের আদিপুরুষ। ইনি ভাদুড়িবংশীয় নিরাবিলপটির কুলীন। তাহিরপুর পরগণার অবশিষ্ট ছয় আনা অংশ হস্তান্তরিত হইয়াছে, এই অংশের একটি দত্তক পুত্র ছিলেন। কিছু দিন হইল তিনিও ইহ সংসার ত্যাগ করিয়াছেন।১০ বিনোদরাম রায়ের বংশধরেরা বর্তমান তাহিরপুর রাজবংশের আলোচ্য বিষয়। বীরেশ্বর রায় নামক জনৈক বিনোদরাম রায়ের পুত্র। ইহার দুই পুত্র চন্দ্রশেখরেশ্বর রায় ও মহেশ্বর রায়। বীরেশ্বর রায় ব্যয়ে সাবধান ছিলেন না। তিনি অনেক টাকা ঋণ রাখিয়া পরলোক গমন করেন। তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র চন্দ্রশেখরেশ্বর রায় বুদ্ধিমান ও ধার্মিক ছিলেন। ইনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ।

ইহার বুদ্ধি কৌশলে এবং রাজকার্য নৈপুণ্যে ইনি পিত-ঋণ অতি অল্পকাল মধ্যে পরিশোধ করিয়া পিতাকে ঋণ পাপ হইতে মুক্ত করেন। ইনিই পিতার সৎপুত্র। ইহারই যত্নে ও সাহায্যে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে একটি “সদাব্রত” রামপুর বোয়ালিয়াতে স্থাপিত হইয়া দৈনিক আহার, মাসিক দান ও পৌষমাসের সংক্রান্তর দিন, দিবার নিয়ম হইয়াছে। চন্দ্রশেখরেশ্বর রায়, অতি বিনয়ী, প্রজার প্রিয় এবং রাজকার্যে দক্ষ ছিলেন। ইহার ভ্রাতৃস্নেহ নিতান্ত প্রশংসনীয় ছিল। মহেশ্বর রায় বড় বুদ্ধিমান ছিলেন না; কিন্তু জ্যেষ্ঠের প্রতি তাহার অতিশয় ভক্তি ছিল। চন্দ্রশেখরেশ্বর ও মহেশ্বর রায়ের রাজা উপাধি না থাকিলেও প্রজারা রাজা বলিত।১১ চন্দ্রশেখরেশ্বর রায়ের একপুত্র শশিশেখরেশ্বর রায়; এবং মহেশ্বর রায়ের চারি পুত্র, জগদীশ্বর, তারকেশ্বর, বিশ্বেশ্বর ও কাশীশ্বর। তন্মধ্যে তারকেশ্বর ও বিশ্বেশ্বর এখন জীবিত আছেন। মহেশ্বর রায়ের বেশি সন্তান বলিয়া ব্রাতৃ স্নেহ নিবন্ধন চন্দ্রশেখরেশ্বর রায় অর্দ্ধাংশ জমিদারি দেওয়া ব্যতীত আরও প্রায় ৫০০০ টাকার ভূসম্পত্তি কনিষ্ঠের পুত্রগণকে দিয়া যান। তথাপি মহেশ্বর রায়ের পুত্রগণ রাজ্য শাসন রীতিমত করিতে না পারায় ঋণ গ্রস্ত হইলেন এবং জমিদারির অনেকাংশ হস্তান্তরিত হইল। কিন্তু শশিশেখরেশ্বর রায় শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। ইনি নিজগুণে গবর্ণমেন্ট হইতে রাজা বাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত হইয়া নাম ও যশ বিস্তার করিয়াছেন। এখন রাজা বাহাদুর বেঙ্গল কাউন্সিলের মেম্বর পদে নিযুক্ত আছেন এবং রাজদরবারে বিশেষ প্রতিপন্ন। সাধারণের হিতকর কার্যে ইনি একজন প্রধান উদযোগী পুরুষ। রাজকুমার কলেজ স্থাপনের জন্য একজন প্রধান অধ্যক্ষ, জমিদার পঞ্চায়িত সভার প্রতিষ্ঠাতাই রাজা শশিশেখরেশ্বর রায় বাহাদুর। ইনি পিতার ন্যায় নিষ্ঠাবন ব্রাহ্মণ বিনয়ী ও সদালাপী। আমরা আশা করি ইহার দ্বারা স্বদেশের অনেক উপকার হইবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে স্থগিত পাঁচ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৩৮)

০৪:৩৯:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

রাজসাহীর রাজা ও জমিদার

মহাভারতীয় বিরাট নগরের ভগ্নাবশেষ, সেনাপতি কীচক বধের নর্তনাগার, অজ্ঞাতবাস সময় পাণ্ডবগণ স্থাপিত দেবমন্দির, মহাভারতীয় “সমী” বৃক্ষের স্থান নয়নপথে পতিত হইবানার সহসা এই প্রশ্নের উদয় হয়, “যে মৎস্য দেশান্তর্গত বারেন্দ্রভূমি রাজসাহী প্রদেশ পাণ্ডবগণের বাসে পুণ্য ক্ষেত্র বলিয়া অদ্যাপিও কীর্তিত হইতেছে, এবং যে প্রদেশের সীমা এককালে ভাগলপুর হইতে ঢাকা পর্যন্ত এবং রঙ্গুর (ঘোড়াঘাট) হইতে বীরভূম ও বীরকিটি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; সেই বিস্তৃত রাজসাহীর অতীত বৃত্তান্ত স্মৃতি পথে উদিত হইলে আমাদের হৃদয় এক অভিনব আনন্দে পরিপূরিত হয় কেন?” এ প্রশ্নের উত্তর- দীর্ঘকাল বিদেশে বাস করার পর স্বদেশ প্রতিগমনে স্বদেশের অতীত বৃত্তান্ত শ্রবণে বা কীর্তনে আমরা যেরূপ আনন্দ অনুভব করি, সেইরূপ রাজসাহীর রাজা ও জমিদারগণের অতীত বৃত্তান্ত কীর্তন করিব বলিয়া আমাদের আনন্দের সীমা রহিল না। প্রাচীন রাজসাহী- প্রাতঃস্মরণীয় লক্ষ্মীস্বরূপা মহারাণী ভবাণীর বাসভবন; যোগী রাজা রামকৃষ্ণের যোগ স্থান; বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের কৌলীন্য প্রথানুযায়ী প্রধান সমাজ ভূমি; নানাবিধ শস্য ক্ষেত্র ও “উৎকৃষ্ট রেশম” উৎপন্ন স্থান- সে পূর্বতন রাজসাহীর কীর্তিকলাপ কীর্তন করা স্বদেশহিতৈষিতা প্রবৃত্তিতে মানবকে চালিত করিয়া থাকে। কিন্তু হায়। দুঃখের বিষয় যে রাজসাহীর জমিদারগণের ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত লুক্কায়িতভাবে আছে অথবা কোন স্থানে অতীত বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করিবার প্রণালী অজ্ঞাতভাব ধারণ করিয়াছে। এরূপ স্থলে প্রকৃত ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত প্রকাশ করা অত্যন্ত কঠিন। লুক্কায়িত ধন কতক পরিমাণে প্রকাশিত হইলে রাজসাহীবাসীরা অবশ্যই আনন্দ অনুভব করিবেন।

 

রাজসাহী রাজা ও উপাধি বিহীন সম্ভ্রান্ত জমিদারগণের সমাজক্ষেত্র। কাহার রাজা উপাধি আছে, কাহার উপাধি নাই। কিন্তু সম্মানে কি রাজদ্বারে, কি জাতীয় সমাজে অনেকেই উচ্চ আসন গ্রহণ করিয়া থাকেন। ইহাদের পূর্বপুরুষদিগের কীর্তিকলাপ এরূপ ছিল যে রাজসাহীতে তাহাদের নাম যশ সর্বজন পরিচিত ছিল। কালের গতি বিচিত্র। কালেই সকল ধ্বংস হয়। অনেক প্রাচীন বংশ ধ্বংস হইয়াছে এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে ইতিবৃত্তিও লোপ হইয়াছে। কেবলমাত্র লোক প্রমুখাৎ বংশের নাম কীর্তিত হইতেছে।

 

রাজসাহীতে তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণের বংশ এবং সাঁতুলের রাজবংশ আদিও প্রসিদ্ধ ছিল। বঙ্গের দ্বাদশ ভৌমিকের অন্তর্গত এই দুইটি “ভৌমিক”-তাহিরপুর ও সাঁতুল। এই প্রাচীন বংশই ধ্বংস হইয়াছে।

 

নাটোরের রাজবংশের অভ্যুদয়ের পূর্বে পুঠিয়া রাজবংশের উৎপত্তি ইতিহাসে কীর্তিত হইয়াছে। বারবকপুর পরগণার রাজা বা জমিদারও অনেক পুরাতন ঘর বলিয়া প্রসিদ্ধ এবং তাহিরপুর এবং সাঁতুল রাজবংশের অভ্যুদয়েরও পূর্বে দুবলহাটি রাজবংশের স্থিতি বলিয়া কথিত আছে। কিন্তু দুবলহাটি রাজ্য একটি ক্ষুদ্র ও অপরিচিত জমিদারি এবং জমিদার নিম্ন জাতীয় শূদ্র বলিয়া তাহার নাম লুক্কায়িত ছিল। নাটোরের রাজবংশ এত প্রসিদ্ধ যে সমগ্র ভারতবর্ষে ইহার খ্যাতি ও নাম অদ্যাপি বর্ণিত হইতেছে। সামান্য অবস্থা হইতে একটি অতি বিস্তৃত রাজোর অধীশ্বর হইয়া মানব-মণ্ডলী শাসনাধীন হইয়াছিল তাহার নাটোর বংশই জাজ্বল্য প্রমাণ।

রঘুননন্দন এই নাটোর বংশের ভীতি স্থাপন করেন। ইতা কদিত হয় যে কোন ব্যক্তি অল্প সময় নাটোর বংশের রাজত্ব সময় তাহিরপুর, পঠিয়া ও সুবলহাটি রাজবংশ ব্যতীত প্রায় সমুদয় রাজ মধ্যে অতিশয় ঐশ্বর্যবান হইলে লোকে তাহাকে বলিয়া থাকে এ বাক্তির ‘রজনী বড়। জমিদার নাটোর রাজের অধীন থাকিয়া পরে ক্রমে স্বাধীন ভূমাধিকারী হইয়া উঠিয়াতেন। আত্রাই ও করতোয়া নদীর মিলন স্থানের নিকট সাঁতুল রাজার প্রাচীন রাজলানীর অরাবণের ভটিগোচর হয়। ইহার নিকটে সাঁততুলের বিল নামে একটি বিস্তৃত জলাশয় বিদ্যমান আছে। সাঁতুলের বিল প্রসিদ্ধ বিলচলনের সহিত সংযোজিত। পূর্বে বিলচলনের পথ ব্যতীত উত্তরবঙ্গে বাণিজ্যতরী গমনাগমনের অন্যপথ ছিল না। একজন রাহ্মণ জমিদার সাঁতুলের রাজা ছিলেন। রাজা গণেশ বা কংসের সময় সাঁতুল রাজ্যের সৃষ্টি হয়। তপ্নে ভাদুড়ি (ভাতুড়িয়া) ও তদন্তরি ২৪১৯৭ টাকার বার্ষিক রাজস্বের ১৩ পরগণা তাহার অধিকৃত ছিল। আত্রাই নদীর উভয় পার্শ্বে ভাতডিয়া প্রদেশ। উড়িষ্যা সুবে বাংলার অধীন। উড়িষ্যা লইয়া এই সুবে বাংলা ২৪ সরকারে বিভক্ত। এই ২৪ সরকারের, সরকার মাহমুদাবাদের অথবা সরকার বাজুয়ার অদীন সাঁতুল রাজ্য। এই রাজ্যের বার্ষিক রাজস্ব আইন আকবরীতে ১৯০৭২৭ দাম লিখিত আছে। যে সময় আরঙ্গজেবের পৌত্র আজিমওযমান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসনকর্তা, সেই সময় সীতানাল সাঁতলের রাজা। তখন তাহার বয়স প্রায় ৫০/৬০ বৎসর। সুতরাং বিষয় কার্মের সমস্ত ভার তাহার কনিষ্ঠ রামেশ্বরের প্রতি অর্পিত হয়। রামেশ্বর অতি বলবান এবং তাহার প্রতাপে উত্তর বঙ্গ কম্পিত হইয়াছিল। রামেশ্বর অতি চতুর ছিলেন। রামেশ্বর জ্যেষ্ঠের অনুগত ছিলেন এবং রাজা সীতানাথও অতিসুধীর ও ধার্মিক এবং কনিষ্ঠের প্রতি তাহার অসাধারণ স্নেহ ও বিশ্বাসে। সীতানাথ দুই বিবাহ করেন। কিন্তু তাহার পুত্র ছিল না। কেবল কনিষ্ঠ রামেশ্বরের এক পুত্র। পুত্রের নাম রামকৃষ্ণ। রাণী সর্বাণীই এই রামকৃষ্ণের পত্নী। সীতানাথের শেষাবস্থায় তাহার কনিষ্ঠ রামেশ্বর নিতান্ত অবিশ্বাসের কার্য করিয়া তাহার জ্যেষ্ঠের হৃদয়কে দগ্ধ করেন। সেই শোক ও দুঃখে রাজা সীতানাথ পরলোক গমন করেন। রামেশ্বরের অধর্মই সাঁতুল রাজ্যের ধ্বংসের মূল কারণ: এবং রামেশ্বরের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসই রাজা সীতানাথের সর্বনাশের হেতু হইয়াছিল।

সাঁতুল ভৌমিক প্রাচীন বংশ এককালে লোপ পাইয়াছে। এই বংশের শেষ রাণী সর্বাণীর মৃত্যুর পর তাহার ভাতুড়িয়া প্রভৃতি বিস্তৃত রাজ্য নাটোর বংশের রঘুনন্দনের হস্তগত হইয়াছিল। “বাংলা ১১১৭ সালে (১৭১০ খ্রিস্টাব্দে) আধুনিক রাজসাহী জেলার অন্যতম প্রধান পরগণা ভাতুড়িয়া ব্রাহ্মণ জমিদার (সান্তোল রাজ) রামকৃষ্ণের পত্নী সর্বাণী দেবীর মৃত্যু হইলে তাহাদের এক মাত্র উত্তরাধিকারী কৃষ্ণরামের ভ্রাতুষ্পুত্র বলরাম জন্মান্ধ ও বধির উল্লেখে জমিদারি কার্য পরিচালনে অসমর্থ বলিয়া ঐ বিস্তীর্ণ জমিদারির কার্যভার তৎকালীন একমাত্র সমর্থ রঘুনন্দনের হস্তে পড়িল। সাঁতুলের রাণী সর্বাণী করতোয়া নদীতটে যে মহাপীঠের আবিষ্কার করেন তাহা দর্শন করিবার জন্য অনেক যাত্রী যাইত। রাণী সর্বাণী কৃত দেবমন্দির আদির জীর্ণ সংস্কার রাণীভবানী করিয়া দেন। ইহাও কথিত আছে যে সাঁতুলের রাজবংশ “পঞ্চপাতকী” বলিয়া প্রসিদ্ধ। কেহ কেহ ইহাও বলিয়া থাকেন যে এই মহাপাপ আশ্রয় করার পর হইতে সাঁতুল রাজবংশ ধ্বংসের সূত্রপাত হয়।

‘বারাহী’, এখন বারীণই নামে প্রসিদ্ধ। এই বারাহী নদীর পূর্বতীরে, রামরামার গ্রামে তাহিরপুরের বিখ্যাত ভৌমিক বংশের রাজধানী ছিল। বারাহী এখন নিতান্ত সঙ্কীর্ণ হইয়া গিয়াছে। রামরামার পশ্চিমে বারাহীর অপর পারে তাহেরপুরে বর্তমান রাজবাটি। সুসঙ্গ রাজবংশের পূর্বপুরুষ মধ্যে বুদ্ধিমন্ত হাজরা নামে একজন বলবান ও সাহসী পুরুষ জন্মগ্রহণ করেন। তাহার বল, বিক্রম ও কৌশলের পরিচয় পাইয়া দিল্লির সম্রাট তাহাকে বঙ্গদেশের পূর্ব দ্বারের জমাদার নিযুক্ত করেন এবং খাঁ ও সিংহ উপাধি দেন। পূর্ব দ্বার-রক্ষা জন্য তাহাকে সৈন্য সামন্ত রাখিতে হইত। সেই ব্যয় নির্বাহ জন্য সম্রাট আসাম ও বাংলার নিকটবর্তী স্থান সুসঙ্গ রাজাকে দেন। এই বুদ্ধিমন্ত খাঁর সময় তাহিরপুরে বিজয় লস্কর’ নামে একজন বীরপুরুষ বর্তমান ছিলেন। ইনি বঙ্গের পশ্চিমদ্বারের জমাদার। সুসঙ্গরাজ পূর্বদ্বার রক্ষক এবং তাহিরপুর রাজ পশ্চিমদ্বার রক্ষক বলিয়া সুসঙ্গ রাজ্য “উদয়াচল” এবং তাহিরপুর রাজ্য “অস্তাচল” নাম ধারণ করে। এই পশ্চিম দ্বার রক্ষার জন্য বিজয় লস্করকে দিল্লির সম্রাট ২২ পরগণা এবং সিংহ উপাধি প্রদান করেন। ইহা দ্বারা সৈন্যগণ প্রতিপালিত হইত। রাজবাটি রামরামায় ছিল এবং সেই স্থানে সৈন্য সামন্ত সহিত গড় আদি ছিল। এই বিজয় সিংহের পুত্র উদয়নারায়ণ বারেন্দ্র কুলীন ব্রাহ্মণগণ মধ্যে নিরাবিল পটির প্রথম সৃষ্টিকর্তা। যে সময় রূপ গোস্বামী গৌড়ের বাদসাহর প্রধান মন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় বাদসাহ সমস্ত রাজ্য উদয়নারায়ণের নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়া কেবল তাহিরপুর পরগণা মাত্র প্রদান করিলেন। সরকার বারবকাবাদের অধীন তাহিরপুর। এই তাহিরপুরের ৫০৫৮২৫ দাম বার্ষিক রাজস্ব ছিল। এই উদয়নারায়ণের পৌত্রই প্রসিদ্ধ রাজা কংসনারায়ণ নান্নাসী গ্রামী (নন্দনবাসী)। পুরুষোত্তম বেদান্তীর বংশে রাজা কংসনারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন। ইনি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। ইনি নন্দনীবাসী, সিদ্ধ শ্রোত্রিয়। কুলীনগণের আশ্রয়দাতা বলিয়া বারেন্দ্র সমাজে পদ গৌরবে কেহই ইহার সমকক্ষ ছিলেন না। কুলশাস্ত্র-বিশারদ উদয়নাচার্য এই নিয়ম করেন যে কুলীন কন্যা শ্রোত্রিয়ে প্রদান রহিত হইবে এবং কুলীনদিগের বিবাহ কুশবারি সংযুক্ত প্রতিজ্ঞা না করিয়া কেবল বাগদানে সম্পন্ন হইবে না। আবার তাহার প্রথম পক্ষীয় বণিতার ছয় পুত্রের সহিত একত্রে শয়নে ও ভোজনে কুলীনের কুলপাত হইতে লাগিল। এই ঘটনা হইতে অনেক কুলীনের কুলপাত হইতে লাগিল। কুলীনগণ ঐ ছয় ভ্রাতার ব্যবহারকে “কাচ” (ছল) বলিয়া স্থির করিলেন। এই “কাচ” হইতে “কাপ” শব্দ প্রসিদ্ধ হইল। উদয়নাচার্যের নিয়মে কুলীন বংশ লোপ হইবার আকার দেখিয়া রাজা কংসনারায়ণ বহুব্যয়ে সমস্ত কুলীন ও কাপকে একত্রিত করিয়া, সেই নিয়ম প্রচলিত করেন যে কাপ কুলীনে কন্যা আদানপ্রদান, কি কুশবারি সংযুক্ত বাগদান, প্রতিজ্ঞা ভিন্ন কুলীনের কুলপাত হইবে না। আবার কাপ দূষিত শ্রোত্রিয়ের কন্যা গ্রহণ করিলে সেই শ্রোত্রিয় উৎকর্ষ লাভ করিবেন। ইহাও বিধি হইল যে কাপ ও কুলীন শ্রোত্রিয়ের কন্যা গ্রহণ করিতে পারিবেন। এই নিয়মে কাপ কুলীনে আহার ব্যবহার প্রচলিত হইল এবং তাহার নিজ বংশের কন্যা কাপে প্রদান করিয়া তিনি সকলের নিকট অতি প্রশংসনীয় ও বারেন্দ্র সমাজে অতি প্রসিদ্ধ হন। রাজা কংসনারায়ণ বারেন্দ্রকুলের মূলাধার ছিলেন। রাজা কংসনারায়ণের প্রপৌত্র “রাজা লক্ষ্মীনারায়ণের কন্যার সহিত নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দনের জ্যেষ্ঠ সহোদর মহারাজা রামজীবনের ঔরস পুত্র রাজকুমার কালিকাপ্রসাদের বিবাহ হয়। কালিকাপ্রসাদের নাম কালু কোঙর বলিয়া ইতিহাসে লিখিত।” তাহিরপুর পরগণার দশ আনা অংশ রাজা কংসনারায়ণের বংশের পরিচয় স্বরূপ। এই বংশের শেষ রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ রায় ছিল। তাহার পুত্রসন্তান ছিল না। তাহার একমাত্র অবিবাহিতা কন্যা উমাদেবীকে রাখিয়া তিনি পরলোকগমন করেন। আনন্দীরাম রায়ের সহিত তাহার বিবাহ হয়। আনন্দীরাম রায়ের মৃত্যুর পর তাহার ভ্রাতা বিনোদরাম রায় ঐ দশ আনা অংশের উত্তরাধিকারী হইলেন। বিনোদরাম রায় অতিশয় বুদ্ধিমান ও চতুর পুরুষ ছিলেন। এই বিনোদরাম রায় বর্তমান তাহিরপুর রাজবংশের আদিপুরুষ। ইনি ভাদুড়িবংশীয় নিরাবিলপটির কুলীন। তাহিরপুর পরগণার অবশিষ্ট ছয় আনা অংশ হস্তান্তরিত হইয়াছে, এই অংশের একটি দত্তক পুত্র ছিলেন। কিছু দিন হইল তিনিও ইহ সংসার ত্যাগ করিয়াছেন।১০ বিনোদরাম রায়ের বংশধরেরা বর্তমান তাহিরপুর রাজবংশের আলোচ্য বিষয়। বীরেশ্বর রায় নামক জনৈক বিনোদরাম রায়ের পুত্র। ইহার দুই পুত্র চন্দ্রশেখরেশ্বর রায় ও মহেশ্বর রায়। বীরেশ্বর রায় ব্যয়ে সাবধান ছিলেন না। তিনি অনেক টাকা ঋণ রাখিয়া পরলোক গমন করেন। তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র চন্দ্রশেখরেশ্বর রায় বুদ্ধিমান ও ধার্মিক ছিলেন। ইনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ।

ইহার বুদ্ধি কৌশলে এবং রাজকার্য নৈপুণ্যে ইনি পিত-ঋণ অতি অল্পকাল মধ্যে পরিশোধ করিয়া পিতাকে ঋণ পাপ হইতে মুক্ত করেন। ইনিই পিতার সৎপুত্র। ইহারই যত্নে ও সাহায্যে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে একটি “সদাব্রত” রামপুর বোয়ালিয়াতে স্থাপিত হইয়া দৈনিক আহার, মাসিক দান ও পৌষমাসের সংক্রান্তর দিন, দিবার নিয়ম হইয়াছে। চন্দ্রশেখরেশ্বর রায়, অতি বিনয়ী, প্রজার প্রিয় এবং রাজকার্যে দক্ষ ছিলেন। ইহার ভ্রাতৃস্নেহ নিতান্ত প্রশংসনীয় ছিল। মহেশ্বর রায় বড় বুদ্ধিমান ছিলেন না; কিন্তু জ্যেষ্ঠের প্রতি তাহার অতিশয় ভক্তি ছিল। চন্দ্রশেখরেশ্বর ও মহেশ্বর রায়ের রাজা উপাধি না থাকিলেও প্রজারা রাজা বলিত।১১ চন্দ্রশেখরেশ্বর রায়ের একপুত্র শশিশেখরেশ্বর রায়; এবং মহেশ্বর রায়ের চারি পুত্র, জগদীশ্বর, তারকেশ্বর, বিশ্বেশ্বর ও কাশীশ্বর। তন্মধ্যে তারকেশ্বর ও বিশ্বেশ্বর এখন জীবিত আছেন। মহেশ্বর রায়ের বেশি সন্তান বলিয়া ব্রাতৃ স্নেহ নিবন্ধন চন্দ্রশেখরেশ্বর রায় অর্দ্ধাংশ জমিদারি দেওয়া ব্যতীত আরও প্রায় ৫০০০ টাকার ভূসম্পত্তি কনিষ্ঠের পুত্রগণকে দিয়া যান। তথাপি মহেশ্বর রায়ের পুত্রগণ রাজ্য শাসন রীতিমত করিতে না পারায় ঋণ গ্রস্ত হইলেন এবং জমিদারির অনেকাংশ হস্তান্তরিত হইল। কিন্তু শশিশেখরেশ্বর রায় শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। ইনি নিজগুণে গবর্ণমেন্ট হইতে রাজা বাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত হইয়া নাম ও যশ বিস্তার করিয়াছেন। এখন রাজা বাহাদুর বেঙ্গল কাউন্সিলের মেম্বর পদে নিযুক্ত আছেন এবং রাজদরবারে বিশেষ প্রতিপন্ন। সাধারণের হিতকর কার্যে ইনি একজন প্রধান উদযোগী পুরুষ। রাজকুমার কলেজ স্থাপনের জন্য একজন প্রধান অধ্যক্ষ, জমিদার পঞ্চায়িত সভার প্রতিষ্ঠাতাই রাজা শশিশেখরেশ্বর রায় বাহাদুর। ইনি পিতার ন্যায় নিষ্ঠাবন ব্রাহ্মণ বিনয়ী ও সদালাপী। আমরা আশা করি ইহার দ্বারা স্বদেশের অনেক উপকার হইবে।