চীনের ২০২০ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দেশটির ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে বিদেশি অভিবাসীর হার মাত্র ০.১ শতাংশ—অন্যদিকে আমেরিকায় এই হার ১৫ শতাংশ। ইতিহাসে চীন কখনও অভিবাসীদের দেশ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে বেইজিং বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। সেই উদ্দেশ্যেই সম্প্রতি চালু হয়েছে নতুন ‘কে–ভিসা’ কর্মসূচি, যার লক্ষ্য বিশ্বের সেরা তরুণ প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞদের চীনে টেনে আনা।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নতুন কৌশল: মার্কিন ‘এইচ–১বি’–এর বিকল্প
দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বসেরা প্রকৌশলী, প্রোগ্রামার ও গবেষকদের প্রধান গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা–তহবিল কমেছে এবং বিদেশি কর্মীদের জনপ্রিয় ‘এইচ–১বি’ ভিসার আবেদনফি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ডলার। এ অবস্থায় চীন নিজেকে উপস্থাপন করছে এক নতুন বিকল্প হিসেবে।
নতুন ‘কে–ভিসা’ আগের তুলনায় অনেক বেশি নমনীয়। এটি বহুবর্ষ মেয়াদি, বহুবার প্রবেশযোগ্য এবং সহজ আবেদনপ্রক্রিয়াসম্পন্ন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো — এই ভিসার জন্য কোনো নিয়োগকর্তার স্পনসরশিপ লাগবে না। ফলে তরুণ STEM (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) স্নাতকেরা চীনে গিয়ে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা, গবেষণা বা নতুন ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।
বিদেশে প্রশংসা, দেশে ক্ষোভ
চীনের বাইরে এই পদক্ষেপকে অনেকেই আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক বলছেন, কিন্তু দেশের ভেতরে প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রধান কারণ — চাকরির সংকট। এ বছরই প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছেন, যাদের বেশিরভাগই প্রকৌশল বিষয়ে ডিগ্রিধারী। কিন্তু অর্থনীতির মন্থরতা এবং কোম্পানিগুলোর নিয়োগ–হ্রাসের কারণে চাকরির বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে।
২০২৫ সালের আগস্টে ১৬–২৪ বছর বয়সী তরুণদের বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ১৮.৯ শতাংশ — যা ২০২৩ সালের পর সর্বোচ্চ। তাই অনেকেই অনলাইনে প্রশ্ন তুলছে, “আমাদের নিজেদের তরুণরাই কাজ পাচ্ছে না, সেখানে বিদেশিদের জন্য দরজা খোলার মানে কী?”
বিদেশভীতি ও অনলাইন জাতিগত উত্তেজনা
এই ক্ষোভের পেছনে আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো বিদেশভীতি। সম্প্রতি এক ভারতীয় উপস্থাপক মন্তব্য করেন, “কে–ভিসা আসলে চীনের এইচ–১বি সংস্করণ — আমাদের কাছে আসুন, আমরা সুযোগ দেব।” এই মন্তব্যের পর চীনা অনলাইন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই ধারণা করছেন, ভারতের মতো দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক কর্মী ঢুকে পড়বে চীনের বাজারে। বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব হলেও এই আশঙ্কা সামাজিক বিভাজন ও জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা বাড়িয়ে তুলছে।
কারা আসবে, কারা নয়: সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা
ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক ড্যান ওয়াং মনে করেন, বাস্তবে ভারত নয়, বরং ইউরোপ ও আমেরিকার মেধাবীরাই প্রথমে এই ভিসার আওতায় আসবে। তিনি বলেন, “বেইজিং খুব সীমিত পরিসরে, কঠোর মানদণ্ডে এই ভিসা দেবে — যাতে এটি লক্ষ্যভিত্তিক নিয়োগের মতো দেখায়।”
চীনের সরকারি দৈনিক পিপলস ডেইলি ৩০ সেপ্টেম্বর এক সম্পাদকীয়তে লেখে, দেশটি এখন “মেধার জন্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত।” তাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে তরুণ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী টানা, “নিম্নমানের শ্রমশক্তি” নয়।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে চীন হয়তো তার প্রবাসী মেধাবীদের — যাদের বলা হয় ‘হাইগুই’ বা ‘সামুদ্রিক কচ্ছপ’ — দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবে। তারা বিদেশে শিক্ষা ও কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে উন্নয়নমূলক ভূমিকা রাখতে পারেন।
নীতির অস্পষ্টতা ও আগাম চ্যালেঞ্জ
তবে এখনো ‘কে–ভিসা’র পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা স্পষ্ট নয়। শুধু বলা হয়েছে — বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা হবে। চীনা সমাজবিজ্ঞান একাডেমির গবেষক লু শিয়াং জানিয়েছেন, আগামী মাসগুলোতে বিস্তারিত নীতি তৈরি হবে। আপাতত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় “নমনীয়ভাবে” আবেদন প্রক্রিয়া চালাবে — যার মানে কী, তা এখনো অস্পষ্ট।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই উদ্যোগ ভবিষ্যতের চীনের জন্য এক ধরনের পরীক্ষা। দ্রুত বয়স্ক জনসংখ্যার দেশে বিদেশি শ্রমশক্তির চাহিদা বাড়বেই, কিন্তু দরজা খুলে দেওয়া আর বাস্তবে গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরি করা — এই দুটি বিষয় এক নয়।
‘কে–ভিসা’ চীনের প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যৎ–কৌশলের অংশ, যা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় দেশটিকে নতুন অবস্থানে নিতে পারে। তবে একই সঙ্গে এটি ঘরোয়া বেকারত্ব, সামাজিক ক্ষোভ, এবং বিদেশভীতি বাড়ানোর আশঙ্কাও রাখে। চীন যদি এই নীতিতে স্বচ্ছতা, ভারসাম্য ও বাস্তবতা বজায় রাখতে পারে, তবে এটি দেশের জনবল সংকট ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
#চীন #কে_ভিসা #প্রযুক্তি #বেকারত্ব #ভূরাজনীতি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট