পুঁঠিয়ার রাজবংশ
লভরপুর পরগণা- উড়িষ্যা সুবে বাংলার অধীন। উড়িষ্যা লইয়া এই সুবে বাংলা ২৪ সরকারকে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য, গজ ইত্যাদি যুদ্ধ সময়ে দিল্লির সম্রাটকে সাহায্য সরকারের বিভক্ত, তন্মধ্যে বারবকাবাদ সরকারের অন্তর্গত লস্করপুর পরগণা। বারবকাবাদ করিতে হইত। এই লস্করপুর পরগণার বার্ষিক রাজস্ব ২৫৫০৯০ দাম ছিল। লস্করপুর পরগণা পদ্মা নদীর উভয় পার্শ্বে স্থিত। এই পরগণার অধিকাংশ গ্রাম বর্তমানে রাজসাহী জেলার অন্তর্গত এবং অল্প সংখ্যক গ্রাম পদ্মা নদীর দক্ষিণ পার্শ্বে নদিয়া ও মুরশিদাবাদ জেলায় স্থিত। ১৩০৫ সালের সালের শ্রাবণ মাসের “উৎসাহে” শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় লিখিয়াছেন যে “কোম্পানির প্রথম আমলে ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় পর্যন্ত লস্করপুর পৃথক কালেক্টরি ছিল। উল্লিখিত সময় পর্যন্ত নিজামতে রেকর্ডে লস্করপুরের কালেক্টরের নিকট হইতে দূরশিলারীর নিজামত এজেন্টের নিকট পত্রাদি দেখা যাইতেছে।” নাটোর বংশের অভ্যুদয়ে রাজসাহী ও লম্বরপুর কালেক্টরি এক হইয়া রাজসাহী জেলা নামে পরিচিত হইল। লস্করপুর বর্তমান পুঠিয়া রাজবংশের প্রধান জমিদারি। পুঠিয়ার রাজারা “ঠাকুর” নামে পরিচিত। পুঠিয়ার রাজবংশ প্রাচীন রাজবংশ বলিয়া ইতিহাসে লিখিত হইয়াছে এই ঠাকুর বা রাজারা পুঠিয়ায় বাস করেন। পুঠিয়া নাটোর ও রামপুরবোয়ালিয়ার প্রায় মধ্যস্থানে অবস্থিত। ইহা কথিত আছে যে এই বিস্তৃত লস্করপুর পরগণা মুরশিদাবাদ সরকারের সংস্রবে জনৈক লস্কর খাঁর জায়গির পুঠিয়ার ঠাকুরেরা প্রাপ্ত হন। এই পরগণার অন্তর্গত আলাইপুর গ্রামে লস্কর খাঁ বাস করিতেন। এই লস্কর খাঁর জায়গির ও তাহিরপুরের আট আনা অংশ সহ, সর্বশুদ্ধ ২২ পরগণার মহাল লইয়া বর্তমান লস্করপুর পরগণার আয়তন গঠিত হয়। বর্তমানে পুঁঠিয়া বংশীয়ের হস্তে সমুদয় লস্করপুর নাই; কিয়দংশ নানা কারণে হস্তান্তরিত হইয়াছে। বর্তমানে লস্করপুর পরগণায় অনেক জমিদার, অন্মধ্যে পাঁচ আনা ও চারি আনার অংশের জমিদারদ্বয়ই শ্রেষ্ঠ। লস্করপুর পরগণার অংশ ব্যতীত ইহাদের অন্যান্য জমিদারিও কম নহে।
পুঠিয়া রাজবংশের উৎপত্তি- পুঁঠিয়ার রাজাগণ বারেন্দ্র শ্রেণি কুলীন ব্রাহ্মণ। ইহাদের
আদিপুরুষ বাগচি বংশীয় সাধু। সাধু হইতে পঞ্চদশ পুরুষের পর, শশধর পাঠক নামে একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করেন। শশধর পাঠকের একমাত্র পুত্র বৎসাচার্য (বৎসরাচার্য)। এই বৎসাচার্যই পুঠিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তন্ত্র ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে একটি প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি গৃহী হইয়া, বিষয় বাসনা শূন্য ছিলেন এবং ঋষির ন্যায় কালযাপন করিতেন। বৎসাচার্যের সাতটি পুত্র, তন্মধ্যে নীলাম্বর, পীতাম্বর এবং পুষ্করাক্ষ জীবিত ছিল এবং অপর চারিটি পুত্রের অকাল মৃত্যু হয়। বৎসাচার্য জীবনের শেষভাগে সন্ন্যাসীর ন্যায় গৃহে বাস করিতেন।
পুঠিয়া রাজবংশের অভ্যুদয় সম্বন্ধে একটি জনশ্রুতি আছে। অতি প্রাচীনকালে পুঠিয়া আশ্রমে বৎসাচার্য (বৎসরাচার্য) নামে ঋষির ন্যায় এক নিষ্ঠান ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। তিনি যাগ, যজ্ঞ, তপস্যায় তাহার অধিকাংশ সময় যাপন করিতেন। তাহার বিষয় বাসনা একবারে ছিল-না। অধিকাংশ সময়ে তিনি নির্জনে বাস করিতেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা করিয়া মোঘল শাসন বিস্তার করেন। তিনি তাহার সমগ্র সাম্রাজ্য পঞ্চদশ প্রদেশ বা সুবায় বিভক্ত করিনা প্রত্যেক প্রদেশে এক এক সুবাদার (সিপাহসালার) নিযুক্ত করেন। সুবাদারদিগের কর্তব্য কর্ম প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত ছিল: (১) সৈনিক বন্দোবস্ত, (২) বিচার ও শান্তিরক্ষণ, (৩) রাজস্ব আদায়। এই পঞ্চদশ সুবা মধ্যে, বারটি হিন্দুস্থানে এবং তিনটি দাক্ষিণাত্যে ছিল। বিজয়পুর ও গলকুন্ডা অধিকারের, পর, শেষোক্ত তিনটি সুবা-স্থলে ছয়টি সুবা হইল। আকবরের সময় অতীত হইলে সুবা বা প্রদেশের কর্তার উপাধি “সিপাহসালার” স্থলে “সুবাদার” হইল। এবং প্রত্যেক প্রদেশ বা সুবার কার্য পর্যবেক্ষণ জন্য একজন “দেওয়ান” উপাধিধারী কর্মচারী নিযুক্ত হইল।” এই পঞ্চদশ সুবা মধ্যে বাংলা একটি সুবা বা প্রদেশ ছিল। আবার বাংলা আঠার প্রদেশ বা সুবায় আকবর বিভক্ত করিয়া প্রত্যেক প্রদেশে এক একজন সুবাদার নিযুক্ত করেন। এই সুবাদারদিগের এই কর্তব্য কর্ম ছিল, যে রাজস্ব আদায় করিয়া বাংলার প্রধান সুবাদার যোগে সম্রাট সমীপে প্রেরণ করিতে হইত। কিন্তু সুবাদারেরা একত্রিত হইয়া স্বাধীন হইয়া উঠিলেন এবং দিল্লির সম্রাট সমীপে রাজস্ব প্রদানে বিরত হইয়া সম্রাটের বিরুদ্ধে উত্থান করিলেন। সম্রাট বিদ্রোহ দমন জন্য কতগুলি উপযুক্ত সৈন্য সমেত একজন সুদক্ষ সেনাপতিকে বাংলায় প্রেরণ করেন। সেনাপতি বৎসরাচার্যের সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিলে, তাহাকে বৎসরাচার্য সৈন্য সমেত তথায় আসিবার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। সেনাপতি বৎসরাচার্যকে বিস্তারিত জ্ঞাপন করিলে, তিনি তাহাকে বিদ্রোহ দমনের উপায় বলিয়া ছিলেন।১০ সেনাপতি কৃতকার্য হইলে পুরস্কার স্বরূপ ঋষিকে কিছু ভূসম্পত্তি দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই সময়ে লস্করপুরের জায়গিরদার লস্কর খাঁ নিঃসন্তান পরলোক গমন করিলে, দিল্লির সম্রাটের অনুমতি লইয়া সেনাপতি, লস্করপুর বৎসরাচার্যকে পুরস্কার স্বরূপ প্রদান করেন। ঋষি বৎসরাচার্য জমিদারিকে তৃণবৎ জ্ঞান করেন; সুতরাং তাহার পুত্র পীতাম্বর জমিদারি গ্রহণ করেন। পীতাম্বর বুদ্ধিমান এবং প্রতিভাশালী ছিলেন। তিনি দিল্লির সম্রাটের অনুগ্রহ লাভ করিয়া লস্করপুর পরগণার অধীশ্বর হইলেন। সম্রাটের মৃত্যুর অল্পদিন পরেই পীতাম্বর প্রাণত্যাগ করেন। সুতরাং নীলাম্বরই সমস্ত সম্পত্তির অধীশ্বর হইলেন। পুঠিয়ার বর্তমান রাজারা সেই নীলাম্বরের বংশধর। পুঁঠিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বৎসরাচার্য এখন দেববৎ পূজিত হইয়া আসিতেছেন। যেহেতুক তাহার কাষ্ঠ-পাদুকা এখনও দেবতার ন্যায় নিত্য পূজা গ্রহণ করিয়া থাকে।