দানব ও মানবতার জগতে ফিরে আসা
অস্কারজয়ী পরিচালক গিলের্মো দেল তোরো আবারও ফিরেছেন তার প্রিয় দানবদের জগতে। মেরি শেলির ১৮১৮ সালের অমর সৃষ্টি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন অবলম্বনে তৈরি এই নতুন চলচ্চিত্রটি ৭ নভেম্বর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাচ্ছে। এখানে বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন (অভিনয়ে অস্কার আইজাক) ও তার সৃষ্ট দানব (অভিনয়ে জ্যাকব এলরডি)-এর সম্পর্ককে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে—একদিকে সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির, অন্যদিকে পিতা ও পুত্রের।
দেল তোরো জানান, শিশুকাল থেকেই তিনি এই কাহিনির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট। তার আগের চলচ্চিত্র পিনোকিও (২০২২), যা সেরা অ্যানিমেটেড ফিচার অস্কার জিতেছিল, এই নতুন ছবির পূর্বসূরি হিসেবে ধরা যায়।
“এটি আমার শৈলীর এক পরিণতি”
টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ৩৫ মিমি প্রিন্টে প্রদর্শনের পর দেল তোরো বলেন, “আমি ৩০ বছরে ১৩টি সিনেমা করেছি। কিন্তু এই সিনেমাটিই আমার প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে। এটি আমার চলচ্চিত্রগত শৈলীর এক যুগের সমাপ্তি এবং নতুন কিছুর সূচনা।”
তিনি আরও বলেন, প্যান’স ল্যাবিরিন্থ, ক্রিমসন পিক এবং দ্য শেপ অফ ওয়াটার—সবগুলো চলচ্চিত্রই তার এই বর্তমান স্টাইলের ভিত্তি তৈরি করেছে।
দুই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা এক গল্প
দেল তোরো ব্যাখ্যা করেন, তিনি গল্পটি দুই দিক থেকে বলতে চেয়েছেন—একজন স্রষ্টা ও তার সৃষ্টির চোখে। “যে মুহূর্তে বিজ্ঞানী ভাবে সে দানবটিকে মেরে ফেলেছে, তখন দানবটি উঠে বলে, ‘এখন আমার গল্প শোনো।’ দর্শক তখন বুঝতে পারে, এটি কেবল ভয়ের গল্প নয়, বরং এক পারিবারিক নাটক—অন্তরঙ্গ এবং বেদনাময়।”
চরিত্র বাছাই: ভাগ্য ও আকস্মিকতার মিলন
অস্কার আইজাককে বেছে নেওয়ার পেছনে পরিচালক বলেন, “ভিক্টর চরিত্রে তার মধ্যে দুর্বলতা ও আবেগের যে মিশ্রণ আছে, সেটিই তাকে অনন্য করেছে।”
প্রথমে ক্রিচারের চরিত্রে অ্যান্ড্রু গারফিল্ডকে নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সময়সূচি না মেলার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এরপর জ্যাকব এলরডি যুক্ত হন। দেল তোরো বলেন, “এখন আমি ভাবতেই পারি না অন্য কেউ এই ভূমিকায় অভিনয় করতে পারত। এই ঘটনাই প্রমাণ করে সিনেমায় আকস্মিকতা কখনও আশীর্বাদ হয়ে আসে।”
কেন দানবদের ভালোবাসেন দেল তোরো
তিনি বলেন, “আমি সবসময় দানবদের পক্ষ নিই, কারণ তারা মানুষের চেয়ে বেশি সৎ। মানুষ প্রতারণা করতে পারে, কিন্তু দানব তার বিকৃতি লুকায় না। আমি মনে করি, তাদের সরলতা ও খোলামেলা স্বভাবই তাদের জাদুকরী করে তোলে। তারা আমার কাছে একধরনের পবিত্র সত্তা।”
মানবতার একমাত্র গুণ: দয়া
দেল তোরো মনে করেন, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন মূলত অসম্পূর্ণতার মধ্য দিয়ে সহাবস্থান ও ক্ষমার গল্প। তিনি বলেন, “লুইস বুনুয়েল বলেছিলেন, বয়স বাড়লে মানুষ বুঝতে পারে একমাত্র সত্য গুণ হলো দয়া। আজকের নিষ্ঠুর পৃথিবীতে এই সিনেমা সেই মানবিকতার কথা মনে করিয়ে দেয়।”
বাস্তব নির্মাণের সৌন্দর্য বনাম ভার্চুয়াল প্রযুক্তি
দেল তোরো বলেন, “আমার কাছে ভার্চুয়াল কিছুই অর্থবহ নয়। আমি সত্যিকারের সেট, হাতে তৈরি পোশাক, মানুষের ছোঁয়ায় পুরনো হয়ে যাওয়া জিনিস দেখতে ভালোবাসি। ডিজিটাল বিস্ফোরণের বদলে হাতে বানানো ক্ষুদ্র মডেল উড়িয়ে দেওয়া—এটাই সিনেমাকে শিল্পে পরিণত করে।”
তিনি মনে করেন, মানুষের হাতের ছোঁয়া ও সৃজনশীলতাই শিল্পকে প্রাণ দেয়—যেমন ভ্যান গঘের তুলির আঁচড়ে বোঝা যায় একজন মানুষ তা এঁকেছেন।
উপসংহার: অসম্পূর্ণতাই সৌন্দর্য
গিলের্মো দেল তোরোর নতুন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কেবল এক ভৌতিক সিনেমা নয়, এটি মানবতা ও অসম্পূর্ণতার উদযাপন। দানব এখানে কেবল ভয়ের প্রতীক নয়—সে ভালোবাসা, একাকিত্ব ও ক্ষমারও প্রতীক। দেল তোরো দর্শকদের মনে করিয়ে দেন, “মানবতার সবচেয়ে বড় গুণ হলো সহমর্মিতা।”
#tags: #ফ্রাঙ্কেনস্টাইন #গিলের্মো_দেল_তোরো #নেটফ্লিক্স #হলিউড_চলচ্চিত্র #মানবতা #দয়া #সিনেমা #সারাক্ষণরিপোর্ট