অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য চীনে গড়ে উঠছে নতুন এক শিল্পভিত্তিক মানবিক উদ্যোগ। সাংহাই চিলড্রেনস আর্ট থিয়েটার ও ব্রিটিশ নাট্যদল ব্যাম্বুজলের যৌথ প্রযোজনায় ‘মুন সং’ নামের নাটকটি শুধু একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয় বরং এটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার উন্মুক্ত পরিসর তৈরি করছে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক থিয়েটারের উষ্ণ অভিজ্ঞতা
সাংহাইয়ের ‘চায়না ওয়েলফেয়ার ইনস্টিটিউট’-এর অংশ হিসেবে রোইওয়ে-সাংহাই চিলড্রেনস আর্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় ৪৫ মিনিটের এই নাটক ‘মুন সং’। নাটকটির মূল চরিত্র মর্গান, যে ঘুমিয়ে এক জগতে যায়—চাঁদের দেশে, যেখানে তার দেখা মেলে রুপালি প্রাণী, উড়ন্ত থালা ও ঝলমলে তারার সঙ্গে।
প্রতিটি প্রদর্শনীতে মাত্র ছয়জন অটিজম আক্রান্ত শিশু অংশ নেয়, যারা একসঙ্গে দর্শক ও নাটকের অংশ হয়ে ওঠে। নাটকের সময় শিশুরা যেভাবে স্বচ্ছন্দবোধ করে, সেভাবেই মঞ্চে নড়াচড়া করতে পারে এবং বসতে বা খেলতে পারে। তাদের কোনো আচরণে বাধা দেওয়া হয় না।
একজন মা, ওয়াং, তার নয় বছর বয়সী ছেলে শাওইউয়ানকে নিয়ে উপস্থিত হন। অটিজমে আক্রান্ত শাওইউয়ান যখন অভিনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখন তার মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে, সেটিই ওয়াং-এর জন্য ছিল বড় জয়। ওয়াং বলেন, ‘এই নাটকে আমার সন্তানকে ঘিরে ছিল বোঝাপড়া, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।’
‘উইশ অব স্টারফিশ’: শিল্পের মাধ্যমে সহায়তা
এই উদ্যোগটি আসলে ‘উইশ অব স্টারফিশ’ নামের এক সামাজিক প্রকল্পের অংশ, যা ২০১৭ সাল থেকে সাংহাই চিলড্রেনস আর্ট থিয়েটার পরিচালনা করছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০টি প্রদর্শনী হয়েছে, যেখানে অংশ নিয়েছে ২,৫০০টিরও বেশি পরিবার।
এই প্রকল্পে অটিজম, ডাউন সিনড্রোম ও সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিভিন্ন রকম ইন্টারঅ্যাকটিভ নাটক আয়োজন করা হয়। যেমন ২০২৩ সালে প্রদর্শিত ‘ডাউন টু আর্থ’ নাটকটি ছিল ফলমূল ও সবজিভিত্তিক এক রঙিন গল্প, যা শিশুদের সংবেদনশীল জগতে আনন্দের সংযোগ তৈরি করে।
প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো, শিল্পের মাধ্যমে এই শিশুদের আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বাড়ানো, যেন তারা নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠতে পারে।
বিদেশি সহযোগিতা ও স্থানীয় অভিযোজন
‘মুন সং’-এর ধারণা আসে ব্রিটিশ, ‘ব্যাম্বুজল থিয়েটার কোম্পানি’ থেকে। চীনে এর অভিযোজিত সংস্করণ তৈরিতে নাটকের সংলাপ, সঙ্গীত ও প্রপস সবকিছু স্থানীয় সংস্কৃতি ও থিয়েটারের পরিবেশ অনুযায়ী সাজানো হয়।
নাটকের অভিনেত্রী চেন শিয়ানশিয়ান বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল না ব্রিটিশ সংস্করণ নকল করা, বরং এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে চীনা দর্শক ও শিশুদের সঙ্গে তা আবেগগতভাবে মিশে যায়।”
ব্যাম্বুজলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টোফার ডেভিস বলেন, “আমরা এমন একটি জায়গা তৈরি করতে চাই যেখানে শিশুরা নিজেদের মতো করে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তারা যা-ই করুক না কেন, সেটিই গল্পের অংশ হয়ে যায়।”
অটিজম ও শিল্পচর্চার ইতিবাচক প্রভাব
অটিজম পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ ইউ ফেই বলেন, “যদিও ‘আর্ট থেরাপি’-র উপর এখনও পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি, তবুও, শিল্প ও থিয়েটারভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম শিশুদের জন্য দারুণ এক সহায়ক পদ্ধতি। এটি তাদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় একটি স্বাভাবিক সেতুবন্ধন তৈরি করে।”
নাটকের সময় শিশুরা শুধু দর্শক নয়, তারা হয়ে ওঠে গল্পের অংশ। তাদের আবেগ, হাসি কিংবা কান্না—সবই থিয়েটারের প্রাণবন্ত মুহূর্তের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।
সরকারি সহায়তা ও সামাজিক উদ্যোগ
চীনের মানবাধিকার উন্নয়নের অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের ‘সিকিং হ্যাপিনেস ফর পিপল’ শ্বেতপত্রে বলা হয়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
২০২৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ফেডারেশন যৌথভাবে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য পাঁচ বছরের একটি বিশেষ কর্মপরিকল্পনা নেয় (২০২৪–২০২৮), যার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা ও সহায়ক অবকাঠামো জোরদার করা।
উদাহরণস্বরূপ, ফুজিয়ান প্রদেশের শিয়ামেন শহরে ২০২৬ সালের মধ্যে প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি হাসপাতাল অটিজম নির্ণয় ও পুনর্বাসন সেবা দেবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঝেজিয়াং প্রদেশের ইয়ংক্যাংয়ে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের পরিবার বছরে সর্বোচ্চ ৩০,০০০ ইউয়ান পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে।
এছাড়া শিল্পভিত্তিক উদ্যোগগুলোও দেশজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে: শানডং, হেইলংজিয়াং ও গুয়াংডং প্রদেশে সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন ও নৃত্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিশেষ শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের দিগন্ত
‘উইশ অব স্টারফিশ’ প্রকল্পটি এখন সাংহাই ছাড়িয়ে নানজিংসহ পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে আরো অঞ্চলে এ কার্যক্রম নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে চীনের প্রতিটি শিশু শিল্পের আলোয় নিজেদের মতো করে উজ্জ্বল হতে পারে।
এক প্রদর্শনীর শেষে অভিনেতারা যখন ছোট দর্শকদের নাম ধরে ‘গুডবাই সঙ’ গাইলেন, তখন শাওইউয়ান হঠাৎ কেঁদে ফেলল। তার মা নরম কণ্ঠে বললেন, “ও এখান থেকে যেতে চায়নি। ও এখানে ভালোবাসা পেয়েছে।”
# চীন, অটিজম, শিশু অধিকার, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা, থিয়েটার, মানবাধিকার, সাংহাই চিলড্রেনস আর্ট থিয়েটার, উইশ অব স্টারফিশ, মুন সং, ব্যাম্বুজল থিয়েটার কোম্পানি