বাংলাদেশের রকসঙ্গীতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর বিদায়ের সাত বছর পরও গিটারের সুরে, কণ্ঠের আবেগে আর সঙ্গীতচিন্তার গভীরতায় তিনি এখনও কোটি ভক্তের হৃদয়ে জীবন্ত। দেশজুড়ে ও প্রবাসে নানা আয়োজনে তাঁকে স্মরণ করছে সঙ্গীতপ্রেমীরা।
সুরের কিংবদন্তিকে স্মরণ
বাংলাদেশের রক সঙ্গীতের ইতিহাসে অনন্য এক নাম আইয়ুব বাচ্চু। আজ শনিবার তাঁর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৮ সালের এই দিনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর মগবাজারে নিজ বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর।
দেশের আধুনিক সঙ্গীত জগতে বিপ্লব ঘটানো এই গিটারিস্ট, গায়ক ও সুরকারকে আজও স্মরণ করছে পুরো জাতি। পরিবার, সহকর্মী, ভক্ত ও সঙ্গীতপ্রেমীরা নানা আয়োজনে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তাঁকে।
স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সন্ধ্যায় মগবাজারের সেলিব্রেশন কমিউনিটি পয়েন্টে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম মিউজিশিয়ানস ক্লাব ঢাকা, আইয়ুব বাচ্চু ফাউন্ডেশন ও বন্ধুমহল।
ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাসুদ জানিয়েছেন, ১৭ অক্টোবর থেকে দেশের বিভিন্ন মসজিদে দোয়ার আয়োজন চলছে। ২০ অক্টোবর চট্টগ্রামে স্থানীয় শিল্পীরা প্রয়াত রক গুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ আয়োজন শেষ করবেন।
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও আইয়ুব বাচ্চু
আইয়ুব বাচ্চুর সুরের যাদু আজও ছড়িয়ে আছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁর জনপ্রিয় গান ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’-এর সহযাত্রী বাচ্চুকে স্মরণ করে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন। সেখানে দেখা যায়, সঙ্গীতশিল্পী খান মঈদুল ইসলাম (ডি-রকস্টার শুভ) বেইজিংয়ে বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে ‘চলো বদলে যাই’ পরিবেশন করছেন।
শুভ জানান, “আমি তাঁর দুটি গান—‘ঘুমন্ত শহরে’ এবং ‘চলো বদলে যাই’ গেয়েছি। বিদেশি কূটনীতিকরাও আমাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন। এটাই প্রমাণ করে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গীত কতটা সার্বজনীন।”
সংগীতজীবনের সূচনা থেকে এলআরবি
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়ার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর বাবা মোহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী ও মা নূরজাহান বেগম।
শৈশবের বন্ধু কুমার বিশ্বজিতের সঙ্গে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ (পরবর্তীতে ‘আগলি বয়েজ’) ব্যান্ডে তাঁর সঙ্গীতজীবনের শুরু। এরপর ‘ফিলিংস’ ও ‘সোলস’-এর সঙ্গে কাজ করেন, যেখানে সহশিল্পী ছিলেন আরেক রক আইকন জেমস। অবশেষে ১৯৯১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ব্যান্ড ‘এলআরবি’ (লাভ রান্স ব্লাইন্ড), যা বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে অনন্য অধ্যায় হয়ে ওঠে।
রূপালি গিটারের কিংবদন্তি
দীর্ঘ চার দশকের সঙ্গীতজীবনে আইয়ুব বাচ্চু প্রকাশ করেছেন ১৬টি একক অ্যালবাম, প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘এবি কিচেন’ স্টুডিও ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রে সুর দিয়েছেন—যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আম্মাজান’, ‘সাগরিকা’, ‘অনন্ত প্রেম’ ও ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’।
তাঁর অমর গানগুলো—‘রূপালি গিটার’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘কষ্ট’, ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’, ‘ফেরারি এই মনটা আমার’, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ ও ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’—আজও বাংলা রক সঙ্গীতের প্রতীক হয়ে আছে।
উত্তরাধিকার ও চিরস্থায়ী প্রভাব
দেশ-বিদেশে এলআরবির কনসার্ট সংখ্যা ছিল ২,৫০০-এরও বেশি; শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সাতটি রাজ্যে টানা পারফরম্যান্স করেছিলেন তাঁরা। তাঁর কণ্ঠ, গিটার ও সঙ্গীতচিন্তা আজও নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।
সাত বছর পেরিয়ে গেলেও ‘রূপালি গিটারের জাদুকর’ আইয়ুব বাচ্চু এখনও কোটি ভক্তের হৃদয়ে জীবন্ত—সুরের ভাষায়, গিটারের সুরে, আর সেই চিরন্তন আহ্বানে—“চলো বদলে যাই।”
# আইয়ুব_বাচ্চু, এলআরবি, বাংলাদেশ_সঙ্গীত, রক_সঙ্গীত, চট্টগ্রাম, সারাক্ষণ_রিপোর্ট