যশোরের আব্দুলপুর ও বাগডাঙ্গা গ্রাম আজ বাংলাদেশের শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র। এখানে কৃষকেরা আধুনিক প্রযুক্তি, পরিশ্রম ও নারী শ্রমের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন এক নীরব কৃষি বিপ্লব, যা দেশের ৬৪ জেলায় উচ্চমানের চারা সরবরাহ করছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি এনে দিয়েছে।
চারার রাজধানী: আব্দুলপুর ও বাগডাঙ্গা
যশোর সদর উপজেলার আব্দুলপুর ও বাগডাঙ্গা এখন দেশের শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। এখানে চলছে এক নীরব কৃষি বিপ্লব। সন্ধ্যা নামলে বা বৃষ্টি শুরু হলে কৃষকরা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেন চারাগুলোকে। কেউ বীজ বপনে ব্যস্ত, কেউ পানি দিচ্ছেন, আবার কেউ বিক্রির জন্য তুলছেন প্রস্তুত চারা।
উৎপাদন ও অর্থনৈতিক পরিধি
স্থানীয় কৃষকদের হিসাবে, আব্দুলপুর ও বাগডাঙ্গার ২৫০–৩০০ জন কৃষক ছয় মাসে ২০–২৫ কোটি সবজির চারা উৎপাদন করেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০–৩০ কোটি টাকা। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, বিট, শালগম, টমেটো ও মরিচসহ এসব চারা দেশের প্রায় সব জেলায় সরবরাহ করা হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা উচ্চমানের চারা সংগ্রহে এখানে ভিড় জমান।
ইতিহাস ও চ্যালেঞ্জ
আব্দুলপুরের কৃষক রেকান মিয়া জানান, প্রায় ২০ বছর আগে এখানে চারা উৎপাদন শুরু হলেও, বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক উৎপাদন গত এক দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে এ বছর একাধিক ধাপে ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। পাশাপাশি বীজ, সার, শ্রম ও পলিথিনের দাম বৃদ্ধি তাদের আর্থিক চাপ বাড়িয়েছে। তিনি সরকারের কাছে ক্ষতি পূরণের আর্থিক সহায়তা চান।
বাজার ও বিক্রয় ব্যবস্থা
বাগডাঙ্গার চাষি সাদ্দাম হোসেন জানান, তাদের চারা অনলাইন ও অফলাইনে বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা সরাসরি এসে চারা কিনে নিয়ে যান। সদর উপজেলার চুরামনকাঠিতে একটি বিশেষ চারা কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে, যা সারাদেশের ক্রেতাদের আকর্ষণ করে।
মামুন হোসেন জানান, বর্তমানে ভালো মানের ফুলকপি চারার দাম প্রতি হাজারে ১,০০০–১,৫০০ টাকা, আর বাঁধাকপি চারার দাম ৮০০–১,১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। তার মতে, সরকারি সহায়তা পেলে এই খাত আরও বিকশিত হতে পারে, কারণ বাণিজ্যিক চারা উৎপাদন ইতোমধ্যেই স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।
নারী শ্রমিকদের ভূমিকা
এই খাতে নারীদের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিক সোহানা খাতুন বলেন, অনেক নারী ছয় মাস ধরে চারার কাজে যুক্ত থাকেন। জুলাইয়ের শুরুতে বীজ বপন শুরু হয়, ৪৫ দিনের মধ্যে বিক্রির উপযোগী চারা তৈরি হয় এবং ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা চলতে থাকে।
তিনি জানান, প্রতিটি বীজতলা বপনের মজুরি ৩৫ টাকা। দিনে ৮–১০ ঘণ্টা কাজ করে একজন নারী শ্রমিক ৫০০–৭০০ টাকা আয় করতে পারেন। চারা সংগ্রহের কাজে প্রতিদিন মজুরি ৫৫০–৬০০ টাকা।
সরকারি সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, আব্দুলপুর ও বাগডাঙ্গার চারা সারা দেশে “অত্যন্ত জনপ্রিয় ও স্বীকৃত।”
তিনি জানান, শুধু এই দুই গ্রাম থেকেই ছয় মাসে ২০–৩০ কোটি টাকার চারা উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে কৃষকরা আয় করেন ২০–২৫ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, কৃষি বিভাগ নিয়মিত প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বাজার সংযোগে সহযোগিতা করছে।
যশোরের আব্দুলপুর ও বাগডাঙ্গা আজ বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত—যেখানে পরিশ্রম, প্রযুক্তি ও নারী অংশগ্রহণ মিলে গড়ে উঠেছে শীতকালীন সবজির চারার প্রাণকেন্দ্র। সঠিক নীতিগত সহায়তা পেলে এই সাফল্য দেশের কৃষি অর্থনীতিতে আরও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
#
যশোর, শীতকালীন সবজি, চারা উৎপাদন, কৃষি উন্নয়ন, নারী শ্রমিক, সারাক্ষণ রিপোর্ট