নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা ও প্রাসঙ্গিকতা
১৩ অক্টোবর স্টকহোমে সংবাদ সম্মেলনে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস ২০২৫ সালের অর্থনীতির নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করে। উদ্ভাবনচালিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে অবদানের জন্য পুরস্কার পান জোয়েল মোকির, ফিলিপ আগিয়োঁ এবং পিটার হাওইট।
ট্রাম্প প্রশাসন পূর্বানুমিতভাবেই নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে বেশি ব্যস্ত। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল ১৩ অক্টোবর ঘোষিত অর্থনীতির পুরস্কারের দিকেও নজর দেওয়া—কারণ তা অনিচ্ছাকৃতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান কিছু সমস্যাকে আলোকপাত করে। এসব সমস্যা ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ পরিকল্পনার বহু আগে থেকে জমা হচ্ছিল এবং সেগুলো অব্যাহত থাকলে দেশকে আবার মহান করার স্বপ্ন ব্যর্থ হবে।
উদ্ভাবন ও ‘সৃজনধ্বংস’—কারা কী পেলেন
এ বছরের পুরস্কারের অর্ধেক গেছে জোয়েল মোকিরের কাছে—তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে উদ্ভাবনের সংস্কৃতি ১৭শ ও ১৮শ শতকের উত্তর ইউরোপে অর্থনৈতিক উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিল। বাকি অর্ধেক ভাগাভাগি করেছেন ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাওইট—তাদের কাজ দেখায়, দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যে ‘সৃজনধ্বংস’-এর (Creative Destruction) ভূমিকা কতটা মৌলিক।
আমেরিকার ঐতিহ্য: উদ্ভাবনের সংস্কৃতি ও হাতে-কলমে জ্ঞান
এই দুই অন্তর্দৃষ্টির সর্বোত্তম উদাহরণই যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের উত্তরাংশ থেকে আগত অভিবাসীরা উদ্ভাবন ও প্রবৃদ্ধির সংস্কৃতি প্রায় হুবহু নিয়ে এসেছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা প্রজন্মের বহু নেতা ছিলেন নিরন্তর উদ্ভাবক—জর্জ ওয়াশিংটন, বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন থেকে শুরু করে টমাস জেফারসন পর্যন্ত (তিনি ঘূর্ণায়মান বই-স্ট্যান্ড থেকে সাইফার-কোডিং চাকা এবং পাস্তার ডো মেশিন—অসংখ্য যন্ত্রের উদ্ভাবক)। আব্রাহাম লিংকনও “অগভীর পানিতে জাহাজ ভাসিয়ে নেওয়ার যন্ত্র” নামে একটি পেটেন্ট নেন—জাহাজের জলরেখার নিচে বসানো ফুলে ওঠা বেলোসের ধারণা; ওই আবিষ্কারের কাঠের মডেল আজও ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আমেরিকান হিস্ট্রিতে আছে।
বেশিরভাগ অগ্রবর্তী বসতির মানুষের কাছে হাতে-কলমে জ্ঞান রপ্ত করা ছিল বেঁচে থাকার প্রশ্ন। মার্ক টোয়েনের “কিং আর্থারের দরবারে এক কানেকটিকাট ইয়াঙ্কি”-র এক চরিত্র বলে, “মানুষের যা দরকার, আমি তাই বানাতে পারতাম—দুনিয়ার যাই হোক; আর যদি কোনো দ্রুত, নতুন কায়দা না থাকত, আমি সেটা আবিষ্কার করে ফেলতাম।” এই ব্যবহারিক জ্ঞানের সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করেছিল সারা দেশে ‘ল্যান্ড-গ্রান্ট’ কলেজ নেটওয়ার্ক—যেখানে পড়ানো হতো ব্যবহারিক কলা-কৌশল—এবং বিশ্বের সবচেয়ে উদার পেটেন্ট ব্যবস্থা।
অগ্রগতির যুগ: নেতৃত্ব ও ‘সৃজনধ্বংস’
১৮৭৫ থেকে ১৯২৬—এই সময়ে বিশ্বের যুগান্তকারী আবিষ্কারের ৪৪ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে; আর ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির হিস্যা ভেসে বেড়িয়েছে ১৪ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যে।
‘সৃজনধ্বংস’-এর ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র ছিল দৃষ্টান্ত। এই ধারণার জনক জোসেফ শুম্পিটার বলেছিলেন, এই বিস্ফোরক সূত্র কাজ করতে দুইটি জিনিস লাগে: স্ব-অনুরক্ত (ইগোম্যানিয়াকাল) উদ্যোক্তা এবং কাঁপুনি ধরানো পরিবর্তন মেনে নিতে প্রস্তুত সমাজ। জন ডি. রকফেলার শোধনাগার সক্ষমতার ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন, আর অ্যান্ড্রু কার্নেগি একা ব্রিটেনের চেয়েও বেশি ইস্পাত উৎপাদন করতেন। তাঁদের এই অতিবড় প্রতিষ্ঠানের পেছনে যেমন ছিল নির্মমতা, তেমনই ছিল নতুন দেশের বিশাল খালি পরিসর ও তরল সামাজিক কাঠামো।
যা টিকে আছে—আর যে সংকট ঘনাচ্ছে
এই সংস্কৃতির অনেকটাই এখনও টিকে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাস্তব উদ্ভাবন আনয়নে তুলনাহীন। প্রযুক্তি জায়ান্টরা অনেকটা ‘রবার ব্যারন’-দের আধুনিক সংস্করণ। ‘বিশ্ব মূল্যবোধ সমীক্ষা’ যুক্তরাষ্ট্রকে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করে।
তবু মোকিরের কথিত সেই ‘খোলা সংস্কৃতি’ আজ যুক্তরাষ্ট্রে নজিরবিহীনভাবে হুমকির মুখে। এর দোষ শুধু ট্রাম্প প্রশাসনের নয়—দশকের পর দশক ধরে প্রগতিশীল বামপন্থী মহলের একাংশ মিশেল ফুকোর মতো আলোকায়নবিরোধী চিন্তককে অতিমাত্রায় পূজা করেছে এবং ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে ‘বাতিল সংস্কৃতি’কে আলিঙ্গন করেছে। কিন্তু ডানপন্থীদের প্রতিক্রিয়া যে দ্বিমুখী আক্রমণে (বিশ্ববিদ্যালয় ও অভিবাসন—দুই ক্ষেত্রেই) এই সংকটকে মহাবিপর্যয়ে পরিণত করতে পারে, তার লক্ষণও স্পষ্ট।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও অভিবাসন: দ্বিগুণ চাপ
‘ওয়োক’ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রশাসনের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ সম্পদ—রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতাকে—হুমকির মুখে ফেলছে। মনে রাখা দরকার, ১৯শ ও ২০শ শতকের শুরুতে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল বিশ্বের সেরা; কিন্তু ১৯১৪-র পর থেকে—বিশেষ করে ১৯৩৩-র পর—দলীয় রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় সেগুলো অধঃপতিত হয়।
একই সঙ্গে এইচ-১বি ভিসায় কড়াকড়ি উচ্চদক্ষ অভিবাসীদের আগমন কমিয়ে দিচ্ছে—যাঁরা পরিসংখ্যানগতভাবে বেশি উদ্ভাবক বা উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনাময়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার সৃজনধ্বংসের স্বাতন্ত্র্যও হারাতে বসেছে। অক্সফোর্ডের কার্ল বেনেডিক্ট ফ্রের নতুন বই “প্রগতির অবসান কীভাবে ঘটে: প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও জাতির ভবিষ্যৎ” দেখিয়েছে, কর্পোরেট একীভবন কীভাবে উদ্যোক্তা-চেতনা শুষে নিচ্ছে।
বাজার ঘনীভবন, সিলিকন ভ্যালির দানব, ও ননকমপিট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিন-চতুর্থাংশ শিল্প এখন ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় বেশি কেন্দ্রীভূত। সিলিকন ভ্যালি আজ আইনি ও জনসংযোগ টিমে সজ্জিত মহাধনীদের করায়ত্ত; তারা হয় স্টার্টআপ কিনে নেয়, না হলে তাদের বাজার থেকে চেপে বের করে দেয়। প্রযুক্তি খাতে ‘প্রতিযোগিতা-নিষেধ’ (ননকমপিট) ধারার ব্যবহারও বেড়েছে—যা সিলিকন ভ্যালির ঐতিহাসিক ‘চাকরি-বদল’ গতিশীলতাকে বেঁধে ফেলছে।
অ্যান্টিট্রাস্টের ইতিহাস—আর আজকের স্থবিরতা
‘গিল্ডেড’ যুগে যুক্তরাষ্ট্র একই রকম সমস্যাকে দমিয়েছিল অ্যান্টিট্রাস্ট আইন ও তৃণমূলের (প্রগ্রেসিভ ও পপুলিস্ট) চাপের সমন্বয়ে। আজ কিন্তু তেমন কোনো শক্ত সংকেত নেই। বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতে, কর্পোরেশনগুলো লবিংয়ে বিপুল বিনিয়োগ করে উদ্ভাবকদের পিষে দেওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়েছে। লক্ষণীয়, ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে যখন দেশের উৎপাদনশীলতার উল্লম্ফন স্তিমিত হতে থাকে, ঠিক তখন থেকেই কর্পোরেট রাজনৈতিক তৎপরতার ঢেউ বাড়তে শুরু করে।
অ্যান্টিট্রাস্ট কর্তৃপক্ষেরা সচরাচর বিদ্যমান আইনও কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন না—তথ্য-দৈত্যদের যুগের উপযোগী নতুন আইন প্রণয়নের কথা তো ছেড়েই দিন। তৃণমূলে ‘সংস্কৃতি যুদ্ধ’-ঘেরা মেরুকরণ এমন পর্যায়ে যে, অ্যান্টিট্রাস্টের মতো কারিগরি এজেন্ডা নিয়ে ঐকমত্য গড়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
ঝুঁকি-বিমুখতার স্রোত ও সৃজনশীলতার ক্ষয়
বিস্তৃত সংস্কৃতিতেও ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা মন্থর। অর্ধেক আমেরিকান রক্তের উইনস্টন চার্চিল ইংরেজিভাষী জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে বলেছিলেন—“আমরা কি শতাব্দী, মহাসাগর, পর্বত আর প্রান্তর পেরিয়ে এসেছি চিনি দিয়ে বানানো বলে?” অথচ অতিউৎসাহী আইনজীবী, স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা বিউরোক্রেসি আর ‘ওয়োক’ যোদ্ধাদের এক বাহিনী সৃজনশীল স্পৃহাকে হত্যা করছে। ফাস্ট-ফুড দোকান গরম পানীয়ের কাপেও সতর্কবার্তা দেয় যে, তা গরম! বিশ্ববিদ্যালয় সতর্ক করে—আর্নেস্ট হেমিংওয়ের “বৃদ্ধ ও সমুদ্র”-এ “গ্রাফিক মাছধরা”র দৃশ্য থাকতে পারে।
ধরা যাক, এই বাড়তি বাধা-বিপত্তিও টিকে গেল—তবু কি প্রচেষ্টার মূল্য মিলবে? ২০০০ সালের আগে আমেরিকানরা দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করত, তাদের সন্তানেরা তাদের চেয়ে ভালো জীবন পাবে। আজ সে আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়েছে। তখন প্রশ্ন ওঠে—ধ্বংস সয়ে কেন এগোব, যদি পুরস্কার হিসেবে সৃষ্টি নয়, স্থবিরতাই মেলে?
তুলনা, ভ্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী, ও ইতিহাসের শিক্ষা
আমেরিকা তার সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করার লম্বা ইতিহাস রাখে। সত্তর-আশির দশকে বিশ্বজোড়া ‘জ্ঞানের লোকেরা’ ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রথম স্থান জাপানের কাছে ছেড়ে দেবে। নতুন ‘জাপান’ হিসেবে যে চীনকে দেখা হয়, তাদের সমস্যাগুলো আসলে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও প্রকট—কর্পোরেট খাতের ঘনীভবন, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের রাজনীতিকরণ এবং নিষ্ক্রিয় অ্যান্টিট্রাস্ট ব্যবস্থা। ইউরোপীয় ইউনিয়নও মারিও দ্রাঘির সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে খুব অগ্রসর হতে পারেনি।
তবু জোয়েল মোকিরের নেতৃত্বে যে ধরনের অর্থনৈতিক ইতিহাসচর্চা—এবং ড্যারন আসেমোগলু, জেমস রবিনসন, বেন বার্ন্যাঙ্কির মতো ইতিহাসমনস্ক অর্থনীতিবিদদের কাজ—সেগুলো দুইটি শক্তিশালী সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়। প্রথমত, অগ্রগতি কখনোই স্বয়ংক্রিয় নয়; সঠিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের ওপরই তা নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত, কোনো অর্থনৈতিক পরাশক্তিই—১০ম-১১শ শতকের সাং রাজবংশের চীন, ১৭শ শতকের ডাচ প্রজাতন্ত্র, কিংবা ১৯শ শতকের ব্রিটেন—জরাজীর্ণতার আগমন ঠেকাতে পারেনি।