ঢাকার পুরনো শহরের প্রাণকেন্দ্র শাঁখারি বাজারে কালীপূজা মানেই এক অনন্য আবহ। সরু গলির আলো, বাতাসে ধূপের ঘ্রাণ, বাজনার তালে তালে ভক্তির উচ্ছ্বাস—সব মিলিয়ে যেন দেবী কালীর আবাহন হয়ে ওঠে জীবন ও ঐতিহ্যের এক উৎসব। কালীপূজার এই আয়োজনে শুধু ধর্ম নয়, জেগে ওঠে পুরান ঢাকার সংস্কৃতি, সহাবস্থান ও সামাজিক বন্ধনের এক দীর্ঘ ইতিহাস।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
শাঁখারি বাজার নামটির উৎপত্তিই এই অঞ্চলের প্রাচীন পেশাজীবী সম্প্রদায় ‘শাঁখারী’দের থেকে। শাঁখ দিয়ে তৈরী গহনা, পূজার সামগ্রী আর অলঙ্কার নির্মাণ ছিল এখানকার প্রাচীন শিল্প। সময়ের স্রোতে সেই শিল্প অনেকটাই হারিয়ে গেলেও, পূজা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য এখনো এই গলিতেই শ্বাস নেয়।
প্রায় তিনশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই উৎসব পুরান ঢাকার ধর্মীয় সহাবস্থানের প্রতীক, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ—সব সম্প্রদায়ের মানুষ মেতে ওঠেন উৎসবে।
প্রস্তুতি ও পরিবেশ
কালীপূজার এক সপ্তাহ আগেই বদলে যায় শাঁখারি বাজারের রূপ। গলির দু’পাশে টাঙানো হয় আলোর মালা, প্যান্ডেল তোলা হয় হাতে গড়া বাঁশের কাঠামোয়, আর কারিগরদের হাত চলে দেবীর মূর্তি গড়ার কাজে। দোকানপাটে ভিড় বাড়ে, ছোট-বড় সবাই মিলে তৈরি করে এক উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত উৎসবের শহর।
পুরো এলাকা যেন এক জীবন্ত রঙের ক্যানভাস—আলো, রঙ, ধূপ আর মন্ত্রের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় এক আধ্যাত্মিক আবহ।
মূর্তি ও মণ্ডপসজ্জা
শাঁখারি বাজারের কারিগররা কালী মূর্তি নির্মাণে বিখ্যাত। তাদের হাতে গড়া দেবীর মূর্তি রঙ, চোখ ও অলঙ্কারে মূর্ত করে তোলে ভক্তির গভীরতা। মণ্ডপগুলো সাজানো হয় ফুল, রঙিন কাপড়, প্রদীপ ও আলোকসজ্জায়।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ওঠে শত শত প্রদীপ—যেন প্রতিটি আলোক শিখা মানুষের ভেতরের অন্ধকার দূর করে নতুন আশার প্রতীক হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় আয়োজন ও আধ্যাত্মিকতা
পূজার রাতে শাঁখারি বাজার জেগে থাকে ভোর পর্যন্ত। দেবী কালীর আরাধনায় ভক্তরা মেতে ওঠেন ধূপ-ধুনোর গন্ধে, ঘণ্টাধ্বনি ও শঙ্খের আওয়াজে। পণ্ডিতদের মন্ত্রোচ্চারণ, অর্ঘ্য প্রদান, আর প্রসাদ বিতরণে পূর্ণ হয় আধ্যাত্মিকতার এক গভীর পরিসর।
এখানে কালীপূজা মানেই ভয়ের দেবীর কাছে আলো ও জ্ঞানের প্রার্থনা—অন্ধকার ও অন্যায়ের প্রতীকী বিনাশের আহ্বান।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
শাঁখারি বাজারের কালীপূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি পুরান ঢাকার সামাজিক মিলনের প্রতীক। উৎসবের দিনে মুসলমান প্রতিবেশীরাও এসে দেখে যান মণ্ডপ, কেউ কেউ অংশ নেন আলোকসজ্জা বা নিরাপত্তার কাজে। এই পারস্পরিক সম্প্রীতি পুরান ঢাকার দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত।
এ সময় দোকানগুলোতে জমে ওঠে ব্যবসা—ফুল, প্রদীপ, পোশাক, মিষ্টি ও প্রসাদের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। একে ঘিরে তৈরি হয় ক্ষুদ্র ব্যবসার এক উজ্জ্বল অর্থনৈতিক চক্র।
চ্যালেঞ্জ ও নিরাপত্তা
উৎসবের ভিড়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় চলাচল ও নিরাপত্তায়। সরু রাস্তা আর মানুষের ঢল সামাল দিতে কাজ করেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল ও পুলিশ। পাশাপাশি, মণ্ডপগুলোতে রাখা হয় অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ও সিসিটিভি।
এ বছর পরিবেশবান্ধব ভাবনায় অনেক মণ্ডপে কমানো হয়েছে মোমবাতি ও কেরোসিন লাইটের ব্যবহার—তার বদলে জ্বলে উঠেছে শক্তি-সাশ্রয়ী LED আলো।
উপসংহার
শাঁখারি বাজারের কালীপূজা একদিকে যেমন পুরান ঢাকার ধর্মীয় ঐতিহ্য বহন করে, তেমনি এটি সংস্কৃতি ও মানবসম্পর্কের উৎসবও বটে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এখানে বিশ্বাস, ঐক্য ও আনন্দ মিলেমিশে গড়ে তুলেছে এমন এক পরম্পরা, যা কেবল দেখা নয়, অনুভব করার বিষয়।
কালীপূজার রাতে যখন শাঁখারি বাজারের প্রতিটি গলি আলোর বন্যায় ভাসে, তখন মনে হয়—পুরান ঢাকার প্রাণ এখনো জীবিত, স্পন্দিত, অনন্ত।
#শাঁখারীবাজার #কালীপূজা #পুরানঢাকা #ঐতিহ্য #ধর্মওসংস্কৃতি #সারাক্ষণরিপোর্ট