তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের পরবর্তী শুনানি ২৮ অক্টোবর নির্ধারণ করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে শুনানি শেষে আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
আদালতের ঘোষণা ও আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া
শিশির মনির বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছিল, তা ছিল ‘পরিকল্পিতভাবে সাজানো প্রক্রিয়া’। তার দাবি, শেখ হাসিনা এই ব্যবস্থা বিলোপের মধ্য দিয়ে ‘একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন’। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, আদালত জুলাই মাসের সনদের ভিত্তিতেই রায় দেবে, যাতে জনগণের আস্থা ফিরে আসে।
বিচারকদের মতামত ও আপিলের পটভূমি
আইনজীবী শিশির মনিরের তথ্যমতে, বর্তমানে ১৪ জন বিচারকের মধ্যে ১০ জনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছেন। এর আগে ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদন গ্রহণ করে সর্বোচ্চ আদালত আপিলের অনুমতি দেয়। এরপর ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার পৃথকভাবে আপিল দাখিল করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক ইতিহাস
১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়।
তবে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন।
২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট রিটটি খারিজ করে এই ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে।
পরে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। আদালত আটজন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে মতামত নেয়।
তাদের মধ্যে ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন।
অন্যদিকে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি এর বিরোধিতা করেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির এই ব্যবস্থার সংস্কারের পক্ষে মত দেন।
বাতিলের রায় ও রাজনৈতিক প্রভাব
২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়।
এরপর থেকে তিনটি জাতীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি আবারও জোরালো হয়।
নতুন রিভিউ আবেদনসমূহ
সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট প্রথমে বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান রিভিউ আবেদন করেন।
পরবর্তীতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৬ অক্টোবর এবং জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ২৩ অক্টোবর পৃথকভাবে একই আবেদন জানান।
এছাড়া নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও একই দাবিতে আবেদন করেন।
মোট চারটি রিভিউ আবেদন একত্রে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানিতে ওঠে।
২৭ আগস্ট আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে আপিলের অনুমতি দেয় এবং পুনরায় শুনানির সিদ্ধান্ত জানায়।
আদালতের এই নতুন শুনানি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করতে পারে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই মামলার রায় ভবিষ্যতের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক ভারসাম্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।
#তত্ত্বাবধায়ক_সরকার #সুপ্রিম_কোর্ট #আপিল_বিভাগ #বদিউল_আলম_মজুমদার #মির্জা_ফখরুল #বাংলাদেশ_রাজনীতি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট