২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে আগের সরকার পতনের পর বাংলাদেশের প্রশাসন এখন গভীর অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত। বিভিন্ন দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেকেই একে অরাজকতার আকার ধারণ করেছে বলে বর্ণনা করছেন। এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, সুশাসন ও সংস্কার বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
সচিব নিয়োগে বিরোধ ও ‘ঠেলাঠেলি’
সম্প্রতি এক উপকমিশনার (ডি.সি.) নিয়োগের সময় শারীরিক সংঘর্ষের ঘটনাকে ঘিরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আমলাদের মধ্যে সচিব পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল নিয়ে অঘোষিত ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলছে।
রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলেও প্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কার্যকর হয়নি। বরং অনেক সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মনে করেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, অদক্ষতা ও ব্যক্তিস্বার্থ বিদ্রোহ-পরবর্তী সময়ে আরও প্রকট হয়েছে।
শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে বড় চ্যালেঞ্জ
একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সচিববিহীন অবস্থায় চলছে। তাঁরা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে জানান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ অধিদপ্তর, পরিকল্পনা বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে কোনো স্থায়ী সচিব নেই।
এর ফলে জ্যেষ্ঠ বা অতিরিক্ত সচিবদের ‘অ্যাকটিং দায়িত্বে’ কাজ করতে হচ্ছে, যা নীতিনির্ধারণ, প্রকল্প অনুমোদন ও জনসেবা প্রদানে স্পষ্ট ধীরগতি সৃষ্টি করছে।
নিরপেক্ষতার প্রশ্নে নতুন বিতর্ক
একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা সচিবালয়ে গিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই ঘটনা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। তাঁর ভাষায়, “অন্তর্বর্তী সরকারের অনিশ্চয়তা, প্রশাসনে দলীয় প্রভাব ও সমন্বয়ের ঘাটতি এই পরিস্থিতির মূল কারণ।”
নিয়োগে অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ
ডি.সি. নিয়োগ ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পুনর্বহনের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগও উঠেছে, বিশেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ঘিরে। তবে সরকার জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ তদন্তে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
সাবেক কর্মকর্তাদের সতর্কবার্তা
সাবেক এক সচিব বলেন, “বিদ্রোহের এক বছর পরও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি।” তিনি সতর্ক করেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও গোষ্ঠীবাদ প্রশাসনে দুর্নীতি, অনিয়ম ও দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি গভীর করছে।
তাঁর মতে, “বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় সচিববিহীন অবস্থায় চলছে, যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করা হচ্ছে—এটি স্পষ্ট প্রশাসনিক ব্যর্থতা।”
প্রশাসনে ‘চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতা’
আরও কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসনে এখন ‘চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতা’ চলছে, যা অবৈধ জমি দখলের মতো আচরণে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলেও পুরনো আনুগত্য, অদক্ষতা ও গোষ্ঠীস্বার্থ এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা ক্ষুণ্ন করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্রোহ-পরবর্তী সময়ের এই প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নই ব্যাহত হবে। তাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন—দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
# বাংলাদেশ, প্রশাসন, অন্তর্বর্তী সরকার, বিদ্রোহ-পরবর্তী পরিস্থিতি, সরকারি কর্মকর্তা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সুশাসন, দুর্নীতি, জনপ্রশাসন, সারাক্ষণ রিপোর্ট