রাস্তায় ভয়, মোড়ে আতঙ্ক
রাজধানীর দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ এলাকা যাত্রাবাড়ী এখন আর কেবল যানজট বা বাণিজ্যের কেন্দ্র নয়—এটি এখন পরিণত হচ্ছে অপরাধের অন্যতম ঘাঁটি। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছুরিকাঘাত, খুন, চাঁদাবাজি বা সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনা ঘটছে।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওয়াপদা কল্যাণী এলাকার লেন নম্বর ১–এ দুই স্কুলছাত্র ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়। তার মাত্র দুই দিন আগে শনির আখড়ায় দোকান ভাঙচুরের সময় এক তরুণকে কোপানো হয়। এর আগের সপ্তাহে কাজলা ব্রিজের নিচে ছিনতাইয়ের সময় আহত হন এক রিকশাচালক।
এই ঘটনাগুলো আলাদা নয়—বরং একটি ধারাবাহিক চিত্র, যা প্রমাণ করছে যাত্রাবাড়ী ক্রমেই পরিণত হচ্ছে ‘আইনশৃঙ্খলাহীন’ অঞ্চলে। এলাকাবাসীর ভাষায়, “এখানে এখন রাস্তায় নামলেই ভয়।”
অপরাধের তিন ছায়া: ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক প্রভাব
স্থানীয়দের মতে, যাত্রাবাড়ীর অপরাধচিত্র এখন তিন ভাগে ভাগ করা যায়—ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দখলবাজি।
ছিনতাই ও ছুরিকাঘাত: সন্ধ্যা নামলেই বাসস্ট্যান্ড, ধোলাইপাড়া, কাজলা ব্রিজ বা মীর হাজীরবাগ এলাকায় ছোটখাটো ছিনতাই নিয়মিত। অনেক সময় প্রতিরোধ করতে গেলে ভুক্তভোগীরা ছুরিকাঘাতের শিকার হন। এক অভিভাবক বলেন, “আমার ছেলে সন্ধ্যায় টিউশনিতে যাওয়ার সময় ভয় পায়, কারণ মোড়েই ছিনতাই হয় প্রায়ই।”

চাঁদাবাজি: রাস্তার পাশে দোকান বসানো, ট্রাক থামানো বা নতুন নির্মাণকাজ—সবকিছুতেই চাঁদা দিতে হয়। “চাঁদা না দিলে রাতে দোকানে হামলা হয়,” বলেন শনির আখড়ার এক ব্যবসায়ী।
রাজনৈতিক প্রভাব: এসব অপরাধের আড়ালে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাব। দলীয় পরিচয়ে কিছু যুবক নিজেদের “সমন্বয়ক” পরিচয় দিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে। কেউ রাজনৈতিক পদে নেই, কিন্তু এলাকায় সবাই জানে—ওদের অনুমতি ছাড়া কিছুই করা যায় না।
‘সমন্বয়ক’ নামের নতুন আতঙ্ক
গত এক বছরে যাত্রাবাড়ীতে “সমন্বয়ক” নামের এক নতুন পরিচয় তৈরি হয়েছে। এই নামে একাধিক গোষ্ঠী এখন এলাকায় চাঁদাবাজি, দখল, এমনকি হামলার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, “সমন্বয়ক”দের অধিকাংশই তরুণ, রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে তারা নিজেরা এলাকা ভাগ করে নিয়েছে। কারো দখলে শনির আখড়া, কারো ধোলাইপাড়া, আবার কেউ কাজলা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে।
একজন দোকান মালিক বলেন, “তাদের মাসোহারা দিতে হয়, না দিলে ব্যবসা চালানো যায় না। থানায় বললেও পরে আরও বিপদ বাড়ে।”
পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
যাত্রাবাড়ী থানার কর্মকর্তারা দাবি করেন, এলাকায় নিয়মিত টহল চলছে এবং সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তদন্তাধীন। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের ভূমিকা প্রায়ই ঘটনাপরবর্তী।
একজন রিকশাচালক বলেন, “ছিনতাই হলে পুলিশ আসে, কিন্তু ততক্ষণে সবাই পালায়। টহল থাকে না।”

আরেকজন অভিভাবক বলেন, “যাত্রাবাড়ীতে রাতে পুলিশের গাড়ি দেখা যায়, কিন্তু ভয়ের পরিবেশ কমে না। কারণ অপরাধীরা জানে—তাদের পেছনে বড় শক্তি আছে।”
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিপন্ন
যাত্রাবাড়ীতে স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরাই এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাই, হয়রানি বা হামলার শিকার হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। সাম্প্রতিক ছুরিকাঘাতে আহত নিয়াজ ও আনাস সেই ভয়াবহ বাস্তবতার অংশমাত্র।
“বাচ্চাদের সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে দিই না,” বলেন এক মা। “আমরা চেয়েছিলাম ওরা পড়াশোনা করুক, কিন্তু এখন ভাবি—জীবনটাই যদি না থাকে, স্কুলে গিয়ে কী হবে?”
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাসের বীজ
যাত্রাবাড়ীর অপরাধের সবচেয়ে গভীর শিকড় রাজনৈতিক প্রভাব। স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে এক শ্রেণির ব্যক্তি নিজেদের ‘ছাত্রনেতা’, ‘সমন্বয়ক’ বা ‘অঞ্চলপ্রধান’ পরিচয়ে বেআইনি কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
পুলিশের ভেতর থেকেও কেউ কেউ স্বীকার করেন, “যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবশালী। তাদের ধরতে গেলে উপরের অনুমতি লাগে।”
এই অব্যবস্থাপনা শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে না, বরং তরুণ সমাজকেও বিপথে ঠেলে দিচ্ছে।
যাত্রাবাড়ী: রাজধানীর অন্ধকার দিক
একসময় যাত্রাবাড়ী ছিল ঢাকার ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র, যেখানে ট্রাক, মালবাহী লরি, পাইকারি বাজার, স্কুল–কলেজ সবকিছু মিলিয়ে জীবন ছিল ব্যস্ত কিন্তু স্থিতিশীল। এখন সেখানে ভয়, দৌরাত্ম্য আর অনিশ্চয়তার ছায়া।

প্রতিদিনের খবরে ছুরিকাঘাত, হত্যাকাণ্ড বা চাঁদাবাজির নতুন অধ্যায় যোগ হচ্ছে।
এলাকাবাসীর দাবি, পুলিশের স্বাধীন ভূমিকা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অভিযান এবং স্থানীয়দের ঐক্য ছাড়া যাত্রাবাড়ীর স্বাভাবিকতা ফিরবে না।
প্রশ্ন একটাই: কবে আসবে শান্তির ভোর?
যাত্রাবাড়ীর প্রতিটি অলিতে গলিতে এখন মানুষের মুখে একটাই কথা—“কবে আবার আমাদের এলাকা নিরাপদ হবে?”
রাজধানীর এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যদি আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ না ফেরানো যায়, তবে তা শুধু যাত্রাবাড়ীর সমস্যা নয়, গোটা ঢাকার জন্যই বিপদ ডেকে আনবে।
যাত্রাবাড়ী, ছিনতাই, ছুরিকাঘাত, চাঁদাবাজি, সমন্বয়ক, রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য, আইনশৃঙ্খলা, ঢাকা, সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















