০৫:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
ইন্দোনেশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক সমঝোতা চূড়ান্তের পথে, জানুয়ারিতে স্বাক্ষরের সম্ভাবনা শিকাগোতে সেনা মোতায়েন আটকাল সুপ্রিম কোর্ট, ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষমতা প্রশ্নের মুখে কুয়েত-চীনের চারশ কোটি ডলারের চুক্তিতে বদলে যাচ্ছে বন্দর ভবিষ্যৎ, জোরালো হবে বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান বোমা আর বাস্তুচ্যুতির মাঝখানে গাজা, ফের ঘরছাড়া হওয়ার আতঙ্কে অবরুদ্ধ মানুষ উত্তর সীমান্তে আকাশজুড়ে আলোর স্তম্ভ বিস্ময়ে মুগ্ধ বাসিন্দারা, বিরল শীতের ইঙ্গিত বিশ্ব কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রিয়াদ: সংঘাত নিরসনে সৌদি আরবের সংজ্ঞায়িত বছর ইয়েমেনে বন্দিবিনিময়ে বড় অগ্রগতি, দুই হাজার নয়শ’ জনের মুক্তিতে সমঝোতা অর্থনীতি টিকে থাকলেও জীবনের চাপে ক্লান্ত আমেরিকা, দুশ্চিন্তায় নতুন বছর রাশিয়ার ভয়াবহ হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামো বিপর্যস্ত, শিশুসহ নিহত তিন আবু ধাবি–দুবাইয়ে বিদেশি ইয়ট চলাচল সহজ হচ্ছে জানুয়ারি থেকে

নীল উপত্যকার টমেটোর গল্পে মিশরীয় স্বাদের ইতিহাস ও নারী ঐতিহ্যের সন্ধান

টমেটোর আগমন ও মিশরীয় রন্ধনের রূপান্তর

উনবিংশ শতাব্দীর আগে মিশরীয় রান্নায় টমেটোর কোনো স্থান ছিল না। অথচ আজ এটি দেশটির অন্যতম প্রধান খাদ্য উপাদান। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের আরবি স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক অ্যানি গাউল তাঁর বই “নাইল নাইটশেড: অ্যান ইজিপশিয়ান কালিনারি হিস্টরি অব দ্য টমেটো”-তে দেখিয়েছেন, কীভাবে এই এক বিদেশি ফল মিশরের সংস্কৃতি ও রান্নার পরিচয়ে গভীরভাবে মিশে গেছে।

লেখক অ্যান মেন্ডেলসন তাঁর পর্যালোচনায় উল্লেখ করেন, গাউল শুধুমাত্র খাবারের ইতিহাস নয়—বরং মিশরের জাতীয় পরিচয়, আধুনিকতা, ঔপনিবেশিক প্রভাব ও নারীদের রান্নার ঐতিহ্যকেও একসঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন।


নদী, ইতিহাস ও জাতীয় পরিচয়ের খোঁজ

নাইল নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তৃত এই দেশটি আরব ঐতিহ্য, ওসমানীয় প্রভাব ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ছাপ বহন করে। ১৯২২ সালে আধা-স্বাধীনতা ও ১৯৫২ সালে পূর্ণ স্বাধীনতার পর মিশরীয় সরকার যখন আধুনিকায়নের পথে হাঁটছিল, তখন রান্নাঘরও সেই জাতীয় আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

টমেটো—যা মূলত মেক্সিকো থেকে আগত নাইটশেড পরিবারের একটি ফল—এই সাংস্কৃতিক রূপান্তরের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। গাউল দেখিয়েছেন, এটি হয়তো ইউরোপ, কিংবা এশিয়া হয়ে মিশরে আসে এবং ধীরে ধীরে প্রতিটি ঘরের রান্নায় স্থান পায়।

টমেটো - উইকিপিডিয়া

কৃষি পরিবর্তন ও বাজারের অস্থিরতা

নাইল উপত্যকার উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া টমেটো চাষের জন্য উপযোগী হলেও ফসল তোলার পর এর নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাই কৃষকদের নির্ভর করতে হয় সার ও সেচের ওপর। আসওয়ান হাই ড্যাম নির্মাণের পর প্রাকৃতিক পলি জমা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে টমেটো উৎপাদন আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে ১৯১০-এর দশকেই মিশরীয়রা টমেটোর দাম নিয়ে অভিযোগ করত, ঠিক যেমন আমেরিকানরা তেলের দামের ওঠানামা নিয়ে করে। সালাহ আবু সাইফের ১৯৫৭ সালের চলচ্চিত্রে দেখা যায়, কীভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তারা কায়রোর রাওদ আল-ফারাগ বাজারে টমেটোর দাম নিয়ন্ত্রণ করে।


রন্ধন সংস্কৃতিতে টমেটোর স্থান

বিশ শতকের শুরুতেই টমেটো ব্যবহৃত হতে থাকে মাহশি নামের ভরাট করা সবজি খাবারে। ধীরে ধীরে ‘সালসা’ (টমেটো সস) মিশরীয় রান্নার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। এমনকি রান্নাঘরে টমেটো ছাঁকার জন্য বিশেষ ছাঁকনি ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

গাউল তাঁর বইয়ের একটি অধ্যায়ে ‘তসবিকা’ নামে এক ঐতিহ্যবাহী টমেটো-ভিত্তিক রান্নার মাধ্যমের কথা বলেন—যা দিয়ে সবজি ও মাংসের স্টু রান্না হয়। আশ্চর্যের বিষয়, তথাকথিত প্রামাণ্য রান্নার বইগুলোতে এর উল্লেখ নেই। অথচ সাধারণ মধ্যবিত্ত নারীরা এটিকে মিশরীয় স্বাদের মূল প্রতীক মনে করেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যা মায়ের কাছ থেকে মেয়ের কাছে পৌঁছায়।

আজ যদিও অনেকেই ক্যানজাত টমেটো ব্যবহার করে, তবুও ‘তসবিকা’ এখনো সেই মিশরীয় ঘ্রাণ ও পারিবারিক স্মৃতির প্রতীক হয়ে আছে।

Amazon.com: Nile Nightshade: An Egyptian Culinary History of the Tomato (Volume 87) (California Studies in Food and Culture): 9780520409132: Gaul, Anny: Books

নারী, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংঘাত

গাউল দেখিয়েছেন, টমেটোর এই সাংস্কৃতিক যাত্রা শুধু খাবারের নয়, বরং নারীর জ্ঞান ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার প্রতীক। আধুনিকতা, বাজার ব্যবস্থা ও বিদেশি প্রভাবের মধ্যেও নারীরা তাঁদের রান্নার মাধ্যমে যে ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন, তা জাতীয় পরিচয়ের এক শক্তিশালী দিক।


ভাষা, স্বাদ ও ‘বালাদি’ ধারণা

গাউল এমন এক গবেষক, যিনি কেবল ইতিহাসবিদ নন, এক বাস্তব রাঁধুনি। তিনি জানেন, ভালো তসবিকার উপরে ঘি বা ‘সমনা’ ভেসে থাকা উচিত। তেমনি, তিনি আরবি শব্দ ‘বালাদি’–র সাংস্কৃতিক অর্থও খুঁজে দেখেছেন। এটি কেবল ‘স্থানীয়’ নয়, বরং এমন কিছুর প্রতীক যা আমদানি বা কারখানায় তৈরি নয়—যেমন দেশীয় ঘি, স্থানীয় মাংস বা রুটি।

এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন নিউ জার্সির এক বেকারি তাদের রুটির নাম দিয়েছে ‘বালাদি আর্টিসানাল ইজিপশিয়ান ব্রেড’।


এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস

নাইল নাইটশেড কেবল একাডেমিক বই নয়; এটি ইতিহাস, রন্ধনশিল্প, নারীজ্ঞান ও জাতীয় আত্মপরিচয়ের এক জটিল ও মুগ্ধকর মিশ্রণ। মিশরের রান্নার প্রতিটি স্তরে টমেটো আজ যে গভীর ছাপ ফেলেছে, তা বোঝাতে অ্যানি গাউল নিঃসন্দেহে এক নতুন জানালা খুলেছেন—একটি দেশের স্বাদ, ঘ্রাণ ও স্মৃতির মধ্য দিয়ে তার আত্মাকে ছুঁয়ে দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে।


#টমেটো #মিশরীয়_রন্ধন #নাইল_নাইটশেড #অ্যানি_গাউল #রন্ধন_ইতিহাস #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

ইন্দোনেশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক সমঝোতা চূড়ান্তের পথে, জানুয়ারিতে স্বাক্ষরের সম্ভাবনা

নীল উপত্যকার টমেটোর গল্পে মিশরীয় স্বাদের ইতিহাস ও নারী ঐতিহ্যের সন্ধান

০১:৩০:৪৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

টমেটোর আগমন ও মিশরীয় রন্ধনের রূপান্তর

উনবিংশ শতাব্দীর আগে মিশরীয় রান্নায় টমেটোর কোনো স্থান ছিল না। অথচ আজ এটি দেশটির অন্যতম প্রধান খাদ্য উপাদান। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের আরবি স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক অ্যানি গাউল তাঁর বই “নাইল নাইটশেড: অ্যান ইজিপশিয়ান কালিনারি হিস্টরি অব দ্য টমেটো”-তে দেখিয়েছেন, কীভাবে এই এক বিদেশি ফল মিশরের সংস্কৃতি ও রান্নার পরিচয়ে গভীরভাবে মিশে গেছে।

লেখক অ্যান মেন্ডেলসন তাঁর পর্যালোচনায় উল্লেখ করেন, গাউল শুধুমাত্র খাবারের ইতিহাস নয়—বরং মিশরের জাতীয় পরিচয়, আধুনিকতা, ঔপনিবেশিক প্রভাব ও নারীদের রান্নার ঐতিহ্যকেও একসঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন।


নদী, ইতিহাস ও জাতীয় পরিচয়ের খোঁজ

নাইল নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তৃত এই দেশটি আরব ঐতিহ্য, ওসমানীয় প্রভাব ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ছাপ বহন করে। ১৯২২ সালে আধা-স্বাধীনতা ও ১৯৫২ সালে পূর্ণ স্বাধীনতার পর মিশরীয় সরকার যখন আধুনিকায়নের পথে হাঁটছিল, তখন রান্নাঘরও সেই জাতীয় আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

টমেটো—যা মূলত মেক্সিকো থেকে আগত নাইটশেড পরিবারের একটি ফল—এই সাংস্কৃতিক রূপান্তরের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। গাউল দেখিয়েছেন, এটি হয়তো ইউরোপ, কিংবা এশিয়া হয়ে মিশরে আসে এবং ধীরে ধীরে প্রতিটি ঘরের রান্নায় স্থান পায়।

টমেটো - উইকিপিডিয়া

কৃষি পরিবর্তন ও বাজারের অস্থিরতা

নাইল উপত্যকার উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া টমেটো চাষের জন্য উপযোগী হলেও ফসল তোলার পর এর নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাই কৃষকদের নির্ভর করতে হয় সার ও সেচের ওপর। আসওয়ান হাই ড্যাম নির্মাণের পর প্রাকৃতিক পলি জমা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে টমেটো উৎপাদন আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে ১৯১০-এর দশকেই মিশরীয়রা টমেটোর দাম নিয়ে অভিযোগ করত, ঠিক যেমন আমেরিকানরা তেলের দামের ওঠানামা নিয়ে করে। সালাহ আবু সাইফের ১৯৫৭ সালের চলচ্চিত্রে দেখা যায়, কীভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তারা কায়রোর রাওদ আল-ফারাগ বাজারে টমেটোর দাম নিয়ন্ত্রণ করে।


রন্ধন সংস্কৃতিতে টমেটোর স্থান

বিশ শতকের শুরুতেই টমেটো ব্যবহৃত হতে থাকে মাহশি নামের ভরাট করা সবজি খাবারে। ধীরে ধীরে ‘সালসা’ (টমেটো সস) মিশরীয় রান্নার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। এমনকি রান্নাঘরে টমেটো ছাঁকার জন্য বিশেষ ছাঁকনি ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

গাউল তাঁর বইয়ের একটি অধ্যায়ে ‘তসবিকা’ নামে এক ঐতিহ্যবাহী টমেটো-ভিত্তিক রান্নার মাধ্যমের কথা বলেন—যা দিয়ে সবজি ও মাংসের স্টু রান্না হয়। আশ্চর্যের বিষয়, তথাকথিত প্রামাণ্য রান্নার বইগুলোতে এর উল্লেখ নেই। অথচ সাধারণ মধ্যবিত্ত নারীরা এটিকে মিশরীয় স্বাদের মূল প্রতীক মনে করেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যা মায়ের কাছ থেকে মেয়ের কাছে পৌঁছায়।

আজ যদিও অনেকেই ক্যানজাত টমেটো ব্যবহার করে, তবুও ‘তসবিকা’ এখনো সেই মিশরীয় ঘ্রাণ ও পারিবারিক স্মৃতির প্রতীক হয়ে আছে।

Amazon.com: Nile Nightshade: An Egyptian Culinary History of the Tomato (Volume 87) (California Studies in Food and Culture): 9780520409132: Gaul, Anny: Books

নারী, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংঘাত

গাউল দেখিয়েছেন, টমেটোর এই সাংস্কৃতিক যাত্রা শুধু খাবারের নয়, বরং নারীর জ্ঞান ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার প্রতীক। আধুনিকতা, বাজার ব্যবস্থা ও বিদেশি প্রভাবের মধ্যেও নারীরা তাঁদের রান্নার মাধ্যমে যে ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন, তা জাতীয় পরিচয়ের এক শক্তিশালী দিক।


ভাষা, স্বাদ ও ‘বালাদি’ ধারণা

গাউল এমন এক গবেষক, যিনি কেবল ইতিহাসবিদ নন, এক বাস্তব রাঁধুনি। তিনি জানেন, ভালো তসবিকার উপরে ঘি বা ‘সমনা’ ভেসে থাকা উচিত। তেমনি, তিনি আরবি শব্দ ‘বালাদি’–র সাংস্কৃতিক অর্থও খুঁজে দেখেছেন। এটি কেবল ‘স্থানীয়’ নয়, বরং এমন কিছুর প্রতীক যা আমদানি বা কারখানায় তৈরি নয়—যেমন দেশীয় ঘি, স্থানীয় মাংস বা রুটি।

এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন নিউ জার্সির এক বেকারি তাদের রুটির নাম দিয়েছে ‘বালাদি আর্টিসানাল ইজিপশিয়ান ব্রেড’।


এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস

নাইল নাইটশেড কেবল একাডেমিক বই নয়; এটি ইতিহাস, রন্ধনশিল্প, নারীজ্ঞান ও জাতীয় আত্মপরিচয়ের এক জটিল ও মুগ্ধকর মিশ্রণ। মিশরের রান্নার প্রতিটি স্তরে টমেটো আজ যে গভীর ছাপ ফেলেছে, তা বোঝাতে অ্যানি গাউল নিঃসন্দেহে এক নতুন জানালা খুলেছেন—একটি দেশের স্বাদ, ঘ্রাণ ও স্মৃতির মধ্য দিয়ে তার আত্মাকে ছুঁয়ে দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে।


#টমেটো #মিশরীয়_রন্ধন #নাইল_নাইটশেড #অ্যানি_গাউল #রন্ধন_ইতিহাস #সারাক্ষণ_রিপোর্ট