অতিপ্রাকৃত ভয়ের সঙ্গে বাস্তবতার সংঘাত
‘ইট: ওয়েলকাম টু ডেরি’ হল স্টিফেন কিংয়ের উপন্যাস It-এর টেলিভিশন স্পিন-অফ, যেখানে নির্মাতা অ্যান্ডি মুশিয়েত্তি ও বারবারা মুশিয়েত্তি এক ভয়াবহ ও প্রাসঙ্গিক গল্প উপস্থাপন করেছেন। পেনিওয়াইজ চরিত্রে বিল স্কারসগার্ড আবারও দর্শকদের আতঙ্কিত করেছেন তাঁর ভয়ঙ্কর অভিনয়ে।
এই সিরিজটি কেবল ভয়ের গল্প নয়; বরং এটি এমন এক সমাজের প্রতিচ্ছবি, যেখানে জাতিগত বৈষম্য, ভীতি এবং মানবিক বিভ্রান্তি একসাথে গেঁথে আছে।
গল্পের প্রেক্ষাপট: ষাটের দশকের ডেরি শহর
গল্পটি ১৯৬২ সালে সেট করা, যা It উপন্যাসের মূল ঘটনার ২৭ বছর আগে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ছোট্ট শহর ডেরির মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক দানবীয় শক্তিকে ঘিরেই শুরু হয় কাহিনি। স্থানীয় সামরিক ঘাঁটি সেই শক্তিকে অস্ত্রে পরিণত করতে চায়। কিন্তু এক কিশোরের রহস্যজনক অন্তর্ধান তাদের এই পরিকল্পনার ভয়াবহতা প্রকাশ করে।
তার বন্ধুরা বুঝতে পারে, এই শক্তি আসলে অশুভ—আর বড়রা কিছুই শুনতে চায় না। তারা তখন আটকে পড়ে ষাটের দশকের যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক বাস্তবতায়—বর্ণবৈষম্য, নাগরিক অধিকার আন্দোলন ও রাজনৈতিক বিভাজনের সময়কালে।

হিংস্রতা ও ভয়: স্টিফেন কিংয়ের জগতের বাস্তব রূপ
‘ওয়েলকাম টু ডেরি’-এর সূচনা থেকেই হিংস্রতা তীব্রভাবে উপস্থিত। এখানে ভয় শুধুই অতিপ্রাকৃত নয়, বরং মানবিক ও সামাজিক। প্রাথমিক দৃশ্যগুলোতেই বোঝা যায়, কোনো চরিত্রই নিরাপদ নয়। এমনকি শিশুদের প্রতিও সহিংসতা দেখানো হয়েছে বাস্তবতার ছোঁয়ায়, অতিরঞ্জিত নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সিরিজটি স্টিফেন কিংয়ের মূল উপন্যাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। এতে কিংয়ের বর্ণনায় সামান্য উল্লেখিত ঘটনাগুলোকেও বিস্তৃত করে নতুন মাত্রা দেওয়া হয়েছে। কিংয়ের বিশ্বজগতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র—পেনিওয়াইজ, বব গ্রে, ডিক হ্যালোরান—এখানে নতুন ব্যাখ্যায় হাজির। অথচ কখনোই মনে হয় না, এগুলো নিছক দর্শক টানার কৌশল; বরং গল্পের প্রয়োজনেই তারা এসেছে।
বাস্তব সমাজের ভয়ের সঙ্গে কল্পনার মেলবন্ধন
এই সিরিজের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো—ষাটের দশকের আমেরিকার বাস্তব ভয়াবহতাকে গল্পের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত করা। জাতিগত নিপীড়ন, পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ, সাদা আধিপত্যবাদ—সবই উঠে এসেছে স্পষ্টভাবে।
জন এফ. কেনেডির আমলের সেই বাস্তব যুক্তরাষ্ট্রে ‘ভিন্নতা’ বা ‘অন্যত্ব’-এর ভয়ই ছিল সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। সিরিজটি সেই ভয়কে দারুণভাবে ব্যবহার করেছে, দেখিয়েছে কেমন করে সমাজের নিজস্ব বৈষম্যই হয়ে ওঠে দানবীয় শক্তির হাতিয়ার।

চরিত্র ও অভিনয়
শিশু চরিত্রগুলোকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে তারা কোনো ক্লিশে বা স্টেরিওটাইপে পরিণত হয়নি। প্রত্যেকেই বাস্তব, জীবন্ত, অনুভূতিশীল। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ক্রিস চক এবং জোভান আদেপো অসাধারণ অভিনয় করেছেন।
ডিক হ্যালোরান চরিত্রে ক্রিস চক এক নতুন গভীরতা এনেছেন। আর বিল স্কারসগার্ড—পেনিওয়াইজ হিসেবে—আবারও সেই ভয়ের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন। পরিচালক অ্যান্ডি মুশিয়েত্তি তাঁকে সীমিতভাবে ব্যবহার করলেও, প্রতিটি দৃশ্যেই তাঁর উপস্থিতি শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দেয়।
স্টিফেন কিংয়ের রূপান্তরের সেরা উদাহরণ
‘ওয়েলকাম টু ডেরি’ নিঃসন্দেহে স্টিফেন কিংয়ের রচনাভিত্তিক সেরা অভিযোজনগুলোর একটি। ‘দ্য গ্রিন মাইল’, ‘মিজারি’, ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ ও ‘দ্য শাইনিং’-এর মতো ক্লাসিকের কাতারেই এটি স্থান পাওয়ার যোগ্য।
সময় যতই গড়াবে, ‘ওয়েলকাম টু ডেরি’ ততই কিংয়ের কিংবদন্তি জগতে নিজের আলাদা অবস্থান তৈরি করবে—এমনটাই মনে হয়।
এই সিরিজটি কেবল একটি ভয়ের গল্প নয়, বরং সমাজের গভীর বাস্তবতা ও মানবিক ভীতির প্রতিচ্ছবি। বিল স্কারসগার্ডের পেনিওয়াইজ যেমন দর্শকদের মনকে কাঁপিয়ে তোলে, তেমনি ষাটের দশকের বাস্তব যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় ও বিভাজনও সমানভাবে আতঙ্কিত করে।
‘ওয়েলকাম টু ডেরি’ তাই একদিকে স্টিফেন কিংয়ের রোমহর্ষক পৌরাণিক জগত, অন্যদিকে মানব সমাজের অন্ধকার বাস্তবতার নিখুঁত মেলবন্ধন।
# স্টিফেন_কিং,# ওয়েলকাম_টু_#ডেরি, #বিল_স্কারসগার্ড, #অ্যান্ডি_#মুশিয়েত্তি, #ওয়েব_সিরিজ,# পেনিওয়াইজ, #হরর_রিভিউ,# সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















