নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের মুখোমুখি
লস অ্যাঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত “মনুমেন্টস” প্রদর্শনী আমেরিকার ইতিহাসে এক বিরল সাহসী প্রয়াস। এখানে একসঙ্গে স্থান পেয়েছে উনিশ শতকের শেষভাগের কনফেডারেট ভাস্কর্য এবং সমসাময়িক কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের কাজ। ধ্বংসপ্রাপ্ত, রঙে দাগ পড়া বা ভেঙে যাওয়া এই প্রতীকগুলো—যেগুলো একসময় দক্ষিণের দাসপ্রথাকে মহিমান্বিত করেছিল—এখন নতুন অর্থে ফিরে এসেছে।
এই প্রদর্শনীর মূল কেন্দ্রবিন্দু শিল্পী কারা ওয়াকারের ১৩ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য “আনম্যানড ড্রোন”, যা গড়ে উঠেছে ভার্জিনিয়ার শার্লোটসভিল শহর থেকে সরানো স্টোনওয়াল জ্যাকসনের ঘোড়সওয়ার মূর্তির ধ্বংসাবশেষ থেকে।
কারা ওয়াকারের “আমেরিকান সেন্টর”
ওয়াকারের সৃষ্ট সেন্টর—অর্ধমানব, অর্ধঘোড়া—আমেরিকার ইতিহাসের ভেতরকার দ্বন্দ্বের প্রতীক। একদিকে দক্ষিণী অফিসারের হাত ঝুলছে, অন্যদিকে তলোয়ার গড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধক্ষেত্রে। এই মূর্তি যেন ক্লান্ত কিন্তু দৃঢ় এক জাতির রূপক, যা অতীতের অন্যায়ের ভারে নত হলেও এগিয়ে চলছে।

২০১৭ সালের “ইউনাইট দ্য রাইট” মিছিলের পর এই জ্যাকসন মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কয়েক বছর পরে ওয়াকার সেই ব্রোঞ্জ টুকরোগুলো সংগ্রহ করে নতুনভাবে সাজান—যেখানে জ্যাকসনের মাথা ঘোড়ার মুখে জোড়া লাগানো, মুখ ঘুরে আছে বিপরীত দিকে। এটি কেবল এক ভাস্কর্য নয়, বরং এক গভীর প্রতীকী সার্জারি—একটি সভ্যতার আত্মসমালোচনা।
“মনুমেন্টস”: অতীত ও বর্তমানের সংঘর্ষ
এই প্রদর্শনীতে এক দশকের মধ্যে সরিয়ে ফেলা প্রায় ডজনখানেক কনফেডারেট স্মৃতিস্তম্ভ তুলে আনা হয়েছে। এগুলোর পাশে স্থান পেয়েছে ১৯ জন সমসাময়িক শিল্পীর কাজ, যাদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। পুরোনো ভাস্কর্যের সাথে নতুন শিল্পের এই সংঘাত ইচ্ছাকৃত—এখানে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা নয়, বরং পুনর্গঠন করা হয়েছে।
প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন হ্যামজা ওয়াকার (দ্য ব্রিক), বেনেট সিম্পসন (MOCA), ও কারা ওয়াকার। ভাস্কর্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বাল্টিমোর, মন্টগোমারি ও ভার্জিনিয়ার কালো ইতিহাস জাদুঘর থেকে।
পুরোনো স্মৃতিস্তম্ভের নতুন পাঠ
দর্শকরা এখানে দেখতে পান, কনফেডারেসির দেবদূত বা জেনারেলরা আর বীর নন; তারা হয়ে উঠেছেন বিশ্লেষণের বস্তু।
উদাহরণস্বরূপ, ফ্রেডেরিক ওয়েলিংটন রুকস্টলের ১৯০৩ সালের ভাস্কর্যে এক দেবদূত পতিত সৈন্যকে কোলে নিচ্ছে—যা এখনো প্রতিবাদীদের লাল রঙে দাগযুক্ত।
আবার লরা গার্ডিন ফ্রেজারের ১৬ ফুট উচ্চতার রবার্ট ই. লি ও স্টোনওয়াল জ্যাকসনের যুগল মূর্তির তলায় এখন লেখা আছে “‘BEWARE TRAITORS’।”
এই প্রদর্শনীতে এসব ভাস্কর্যকে প্রথমে শিল্পকর্ম হিসেবে দেখা হচ্ছে, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক বোঝা মুছে ফেলা হয়নি।

ভেঙে পড়া গৌরবের ভেতর থেকে নতুন শিল্প
কনফেডারেট যুগের এসব ভাস্কর্য—যেগুলো একসময় বর্ণবাদের প্রচারযন্ত্র ছিল—এখন নতুন প্রেক্ষাপটে দেখা হচ্ছে। ইনডোরে প্রদর্শিত বিশাল মূর্তিগুলো যেন নিজেদের ভারেই ভেঙে পড়ছে। এগুলোকে এখন ইতিহাসের বস্তু নয়, বরং “জিম ক্রো” যুগের প্রচারণা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
দর্শকরা বুঝতে পারেন, কীভাবে দাসপ্রথাকে রোমান্টিক করে তুলতে শিল্প ব্যবহার করা হয়েছিল—মা কাঁদছে ছেলেকে দেখে, জেনারেল তাকিয়ে আছে দূরে—এগুলো সবই ছিল “লস্ট কজ” মতবাদের অংশ।
২০০ ভাস্কর্য সরানো, ৭০০ এখনো টিকে
গত দশকে ২০০টিরও বেশি কনফেডারেট ভাস্কর্য অপসারিত হয়েছে, কিন্তু ৭০০ এখনো টিকে আছে। এমনকি কিছু আবার ফিরেও আসছে। সম্প্রতি পেন্টাগন ঘোষণা করেছে, ২০২৩ সালে সরানো একটি কনফেডারেট স্মৃতিস্তম্ভ আবার আরলিংটন সমাধিক্ষেত্রে পুনঃস্থাপন করা হবে।
ডিফেন্স সেক্রেটারি পিট হেগসেথ বলেন, “আমরা ইতিহাস মুছে ফেলব না; আমরা তা পুনরায় স্থাপন করছি।”
“কাউন্টারমোনুমেন্ট” আন্দোলন ও সমসাময়িক শিল্প
প্রদর্শনীতে রয়েছে নানা ধরনের আধুনিক কাজ—স্ট্যান ডগলাসের “বার্থ অফ এ নেশন” নামের ভিডিও ইনস্টলেশন, যেখানে ডি.ডব্লিউ. গ্রিফিথের একই নামের কুখ্যাত ছবিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কেভিন জেরোম এভারসনের কৃষ্ণ-সাদা চলচ্চিত্রে দেখা যায় এক কর্মী কীভাবে ১৯৮০-র দশকে একটি কনফেডারেট পতাকা নামাচ্ছেন।
আরও আছে লিওনার্দো ড্রুর তুলার তৈরি মিনিমালিস্ট স্মৃতিস্তম্ভ, নোনা ফাউস্টিনের নগ্ন আত্মপ্রতিকৃতি ওয়াল স্ট্রিটের দাসবাজারে—সবই “কাউন্টারমোনুমেন্ট” ধারণার উদাহরণ, যেখানে ইতিহাসকে সরাসরি না বলে প্রতীকী ও বিমূর্তভাবে স্মরণ করা হয়।
ইতিহাসের ভেতর থেকে পুনর্গঠন
কারা ওয়াকারের “আনম্যানড ড্রোন” যেন এক পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা—ধ্বংস নয়, বরং স্থিতিশীলতার প্রতীক। তিনি দেখান, কীভাবে এক শতাব্দীর পুরোনো ব্রোঞ্জ মূর্তি খুলে তার অন্তর্গত কাঠামো উন্মোচন করা যায়।

যেভাবে সেন্টর এক অদ্ভুত জীব—মানব ও ঘোড়ার মিশ্রণ—তেমনি আমেরিকাও তার দ্বৈত অতীতের ভার বহন করছে। ওয়াকারের এই সৃষ্টিতে সেই জটিল ইতিহাস একাকার হয়ে নতুন এক প্রতিরূপে রূপান্তরিত হয়েছে—যেখানে শিল্প ও ইতিহাস, অপরাধবোধ ও আত্মসমালোচনা, এক শরীরে মিশে গেছে।
“মনুমেন্টস” আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ইতিহাস কেবল অতীতের বিষয় নয়—এটি পরিবর্তনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পতিত ভাস্কর্যগুলো এখন আর বর্ণবাদের প্রতীক নয়, বরং আমেরিকার নতুন আত্মজিজ্ঞাসার আয়না।
#tags: #আমেরিকানশিল্প #কনফেডারেটইতিহাস #কারা_ওয়াকার #মনুমেন্টস #সমসাময়িকশিল্প #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















