সূর্যের দেশ আফ্রিকা, অথচ অন্ধকারে কোটি মানুষ
বিশ্বে এখনো প্রায় ৬৬ কোটি মানুষ বিদ্যুৎবিহীন জীবন কাটাচ্ছে, যার ৮৫ শতাংশই সাহারা-দক্ষিণ আফ্রিকায়। কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের বারাকা গ্রামের ওয়াশিকালা মালাঙ্গো ছিলেন তাদেরই একজন। ছোটবেলায় সন্ধ্যা নামলেই ম্লান কেরোসিনের আলোয় রাত কাটাতে হতো তাকে। পর্যাপ্ত কেরোসিন কেনার সামর্থ্য ছিল না, ফলে রাতের পড়াশোনা অসম্ভব হয়ে পড়ত। এক রাতে জ্বালানো মোমবাতি থেকে আগুন লেগে তার বিছানা পুড়ে যায়—সেই স্মৃতি আজও তার মনে গেঁথে আছে।
গৃহযুদ্ধের সময় মালাঙ্গো ও তাঁর বন্ধু ইয়োঙ্গা মাশাঙ্গাও তানজানিয়ার এক শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে যান। সেখানেও বিদ্যুৎ ছিল না। এই কষ্ট থেকেই জন্ম নেয় তাদের পরিবর্তনের ইচ্ছা। ২০১৩ সালে তারা প্রতিষ্ঠা করেন আলটেক (Altech)—একটি স্টার্টআপ, যা সহজে ইনস্টলযোগ্য সৌর কিটের মাধ্যমে অফ-গ্রিড পরিবারে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়।
আফ্রিকার অগাধ সৌরসম্পদ
৫৪টি দেশের আফ্রিকা পৃথিবীর অন্য যেকোনো মহাদেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সূর্যালোক পায়। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলছে, এই অঞ্চলের সৌরশক্তির সম্ভাবনা “প্রায় সীমাহীন”। তবুও ২০২৪ সালে মহাদেশজুড়ে স্থাপিত সৌর ক্ষমতা ছিল মাত্র ২১.৫ গিগাওয়াট—যেখানে তুলনামূলকভাবে চীন শুধু পাঁচ মাসে ১৯৮ গিগাওয়াট নতুন সংযোগ দিয়েছে।
বাধা কোথায়?
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (IEA) জানায়, আফ্রিকার জনসংখ্যা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার কারণে বিদ্যুৎ গ্রিড সম্প্রসারণ ব্যয়সাপেক্ষ ও জটিল। অবকাঠামোগত ঘাটতি, নীতিগত অস্পষ্টতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাত অনেক দেশেই সৌর প্রকল্পকে থামিয়ে দিয়েছে। বড় মাপের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেও বিপুল প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা অনেক দেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
বৃহৎ উদ্যোগ ও ধীর অগ্রগতি
এই সংকট মোকাবিলায় চলছে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। “মিশন ৩০০”–এর আওতায় ২৯টি দেশ নীতিগত সংস্কার আনছে, যার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৩ কোটি মানুষ বিদ্যুৎ পেয়েছে। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ‘ডেজার্ট-টু-পাওয়ার’ উদ্যোগ ২০১৮ সালে শুরু হয়, যার লক্ষ্য সাহেল অঞ্চলের ১১টি দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ গিগাওয়াট সৌরশক্তি স্থাপন। এতে ২৫ কোটি মানুষ উপকৃত হওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচ বছরের বেশি সময় পার হলেও এর ক্ষুদ্র অংশই অর্থায়ন পেয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা—যেমন গত তিন বছরে পাঁচটি অভ্যুত্থান—প্রকল্পের অগ্রগতিকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।

বিনিয়োগের ঘাটতি ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
গত দুই দশকে আফ্রিকা বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিনিয়োগের মাত্র ২ শতাংশ পেয়েছে। IEA অনুমান করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মহাদেশে সর্বজনীন বিদ্যুৎ সরবরাহে বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। যদিও বেসরকারি খাতে আগ্রহ বাড়ছে, তা এখনো চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
অফ-গ্রিড সৌর: আলো পৌঁছানোর বিকল্প পথ
IEA-র তথ্যমতে, আগামী পাঁচ বছরে সৌরখাতে যে সম্প্রসারণ হবে, তার ৪২ শতাংশই আসবে ক্ষুদ্র-স্কেল বা অফ-গ্রিড সিস্টেম থেকে। বিশ্লেষক হেইমি বাহার বলেন, গৃহস্থালী সৌর কিট ও মিনি-গ্রিড ব্যবস্থা “মূল গ্রিড আসার আগ পর্যন্ত সেতুবন্ধনের ভূমিকা রাখবে।”
সৌর প্রযুক্তির খরচ ক্রমেই কমছে, যা ডিজেল জেনারেটরের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী। কিন্তু প্রাথমিক মূলধন এখনো বড় বাধা—বিদ্যুৎবিহীন পরিবারের মাত্র ২২ শতাংশ ‘টিয়ার-১’ সৌরকিট কেনার সামর্থ্য রাখে, যা দিনে চার ঘণ্টা আলো দিতে পারে। তাই সরকারি অর্থায়ন, ক্ষুদ্রঋণ ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আলটেকের মডেল: সহজ কিস্তিতে সৌরবিদ্যুৎ
আলটেক তাদের গ্রাহকদের কিটের দাম কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে। কঙ্গোতে গড় দৈনিক আয় মাত্র ৩.৯২ ডলার, ফলে ১৩ ডলারের সৌরল্যাম্প অনেকের পক্ষে কেনা কঠিন। ২০২২ সালে তারা চালু করে মোবাইল পেমেন্ট ভিত্তিক “পে-অ্যাজ-ইউ-গো” ব্যবস্থা। এতে গ্রাহকরা ৫০ সেন্ট প্রতিদিন দিয়ে ১০০ দিনে লাইটিং সিস্টেম বা ১ ডলার দৈনিক দিয়ে পাঁচ বছরে রান্নার চুলা ও ফ্রিজসহ পূর্ণ “পাওয়ার সিস্টেম” নিতে পারেন।
সবচেয়ে জনপ্রিয় প্যাকেজে দুটি ৫০-ওয়াট সৌর প্যানেল থাকে, যা টিভি, রেডিও, সাউন্ডবার, ফ্যান, চার্জার ও দুটি বাল্ব চালাতে সক্ষম। তিন বছরে কিস্তি শেষ হয়। এতে বছরে শত ডলার সাশ্রয় হয়, যা আগে কেরোসিনে ব্যয় হতো।
জীবনের মানোন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তন
সৌর সিস্টেম শুধু খরচ কমায় না—জীবনও বদলায়। শিশুদের পড়াশোনার সময় বাড়ে, ধোঁয়া ও আগুনের ঝুঁকি কমে, ঘরের বাতাস হয় পরিষ্কার। আগে মোবাইল চার্জ করতে মানুষ ডিজেলচালিত দোকানে গিয়ে ১ থেকে ৩ ডলার খরচ করত, এখন ঘরে বসেই চার্জ দিতে পারে।
এ পর্যন্ত আলটেক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ২৫ লাখের বেশি মানুষকে আলো দিয়েছে।
আফ্রিকার নবীন উদ্যোক্তা ও নতুন শক্তির দিগন্ত
আইইএর তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সাহারা-দক্ষিণ আফ্রিকায় যত নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশই অফ-গ্রিড সৌর ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই ধারা নেতৃত্ব দিচ্ছে বহু স্টার্টআপ:
- এম-কোপা (M-Kopa): কেনিয়ায় ২০১১ সালে শুরু হয়ে এখন ডিজিটাল ফাইন্যান্স ও ই-মোবিলিটি খাতে প্রসারিত।
- ইজিলি (Izili, পূর্বে Baobab+): নাইজেরিয়া, সেনেগাল, মাদাগাস্কার ও আইভরি কোস্টে ২১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সংগ্রহ করে ২০ লাখ মানুষকে সৌরকিট দিয়েছে।
- লাইটবক্স আফ্রিকা (LightBox Africa): দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে তিন বছরে কিস্তি পরিশোধে সৌরকিট সরবরাহ করছে।
- নুরু (Nuru): কঙ্গো ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, ২০২৩ সালে ৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন পেয়ে সাহারা-দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় মিনি-গ্রিড প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
আলোর পথে আফ্রিকা
যুবসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকায় (যেখানে ৭০% মানুষ ৩০ বছরের নিচে), অফ-গ্রিড সৌর ব্যবস্থা তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে। বিশ্লেষক ব্রুনো ইদিনির ভাষায়, “এটি এক দুষ্টচক্র—বিদ্যুৎ নেই বলে আয় হয় না, আর আয় নেই বলে বিদ্যুৎ আসে না। সৌরহোম সিস্টেম ও মিনি-গ্রিড এই চক্র ভাঙতে পারে।”
# আফ্রিকা, সৌরবিদ্যুৎ, অফ গ্রিড, নবায়নযোগ্য_শক্তি, আফ্রিকান_ডেভেলপমেন্ট_ব্যাংক, জ্বালানি_সংকট, আলটেক, মিনি_গ্রিড, নবীন_উদ্যোক্তা, টেকসই_উন্নয়ন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















