কর্পোরেট দুনিয়ায় বড় ধাক্কা: হাজারো কর্মী চাকরিহারা
যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম নিয়োগদাতারা এক ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে—অফিসকর্মীদের আর তেমন প্রয়োজন নেই। আমাজন জানিয়েছে, তারা প্রায় ১৪ হাজার কর্পোরেট পদ বাদ দেবে, যা তাদের সাদা কলার কর্মীসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। ইউনাইটেড পার্সেল সার্ভিস (ইউপিএস) জানায়, গত ২২ মাসে তারা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে প্রায় ১৪ হাজার পদ বিলুপ্ত করেছে। এর কয়েক দিন আগেই খুচরা বিক্রেতা টার্গেট ১,৮০০ কর্পোরেট পদ ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়। অক্টোবরের শুরুতেই রিভিয়ান, মলসন কুরস, বুয অ্যালেন ও জেনারেল মোটরসসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের ছাঁটাইয়ের খবর আসে।
এই ধারাবাহিক ছাঁটাই যুক্তরাষ্ট্রে এক নতুন শ্রম বাস্তবতা তৈরি করছে—বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন খরচ কমাতে গভীর কাটছাঁট করছে, বিশেষ করে অফিসভিত্তিক কর্মীদের ক্ষেত্রে। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়ে পড়ছেন স্থবির শ্রমবাজারে। সরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ মার্কিন নাগরিক ২৭ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে বেকার।
বাস্তব অভিজ্ঞতা: এক সকালে ‘চাকরিহীন’ হয়ে যাওয়া
অস্টিন, টেক্সাসের ৫৫ বছর বয়সী কেলি উইলিয়ামসন মঙ্গলবার ভোরে একটি মেসেজ পান—“ইমেল চেক করুন এবং আজ কাজে যাবেন না।” আমাজনের সহযোগী সংস্থা হোল ফুডস মার্কেটে তার পদটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তার ব্যাজ ও ল্যাপটপ নিষ্ক্রিয় করা হয়, অফিসের জিনিসপত্র ডাকযোগে পাঠানো হবে জানানো হয়। কোম্পানির অন্য কোনো পদে যোগ দেওয়ার জন্য তাকে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়।

এআই, বিনিয়োগকারী চাপ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা: ছাঁটাইয়ের মূল কারণ
কর্মী ছাঁটাইয়ের পেছনে অন্যতম কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)। অনেক প্রতিষ্ঠান মনে করছে, এআই এখন এমন কাজও করতে পারে যা একসময় উচ্চবেতনভুক্ত কর্মীরা করতেন। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা পরিচালকদের ওপর চাপ দিচ্ছেন কম কর্মী দিয়ে বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করতে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যয় বৃদ্ধিও নিয়োগপ্রক্রিয়া ধীর করেছে।
অন্যদিকে, নীল কলার বা দক্ষ হাতে কাজ করা শ্রমিকদের চাহিদা বাড়ছে—বিশেষত স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণ, আতিথেয়তা ও কারিগরি খাতে।
ভারী দায়িত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
অফিসে যারা থেকে গেছেন, তাদের ওপর পড়ছে বাড়তি কাজের চাপ। অনেক ম্যানেজারকে এখন বেশি কর্মী তদারকি করতে হয়, কিন্তু সময় কমে গেছে। কর্মক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চয়তা ও ভয়ের পরিবেশ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ মনে করেন তারা সহজে ভালো চাকরি পেতে পারেন—যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
নীল কলার খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
যেখানে অফিসের চাকরি কমছে, সেখানে বাড়ছে ফ্রন্টলাইন বা নীল কলার খাতে সুযোগ। ট্রেড, স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণ ও আতিথেয়তা খাতে কর্মীর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, পরামর্শক, খুচরা ও আর্থিক খাতে ছাঁটাই চলছে। কোম্পানিগুলো এখন হিসাবরক্ষণ ও প্রতারণা শনাক্তকরণে এআই ব্যবহার করছে।
‘প্রযুক্তি বিক্রেতা থেকে গাড়ি বিক্রেতা’—এক কর্মীর গল্প
৩৩ বছর বয়সী ক্রিস রিড প্রযুক্তি বিক্রয়ের চাকরি হারিয়ে দশ মাস ধরে কাজ খুঁজেও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত তিনি টেক্সাসে টয়োটা গাড়ির বিক্রেতা হিসেবে কাজ নেন। তিন সন্তানের এই পিতা সংসার চালাতে 401(k) সঞ্চয় ভেঙেছেন, স্টক ও ক্রিপ্টো বিক্রি করেছেন, এমনকি ছেলের সঙ্গে সংগ্রহ করা পোকেমন কার্ডও বেচেছেন। বন্ধক পরিশোধ না করতে পারায় তার বাড়ি নিলামে উঠেছে।
এখন তিনি প্রতিদিন দুই ঘণ্টা যাতায়াত করেন, সকাল ৮টা ৩০ থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করেন, আর অনেক দিন সন্তানদের দেখা পর্যন্ত পান না।
ডিগ্রিধারীদের জন্যও ঝুঁকি
একসময় যে অফিসপদগুলো ছিল সচ্ছল ও আকর্ষণীয়—যেমন হিসাবরক্ষক, মানবসম্পদ কর্মকর্তা, প্রকৌশলী—আজ সেগুলোই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব ফিলাডেলফিয়ার গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ ডিগ্রিধারী ও উচ্চ বেতনের চাকরিগুলোই এআই দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে।
অর্থনীতি বাড়লেও নিয়োগের গতি মন্থর। অনেক প্রতিষ্ঠান এখন অভিজ্ঞ কর্মী বা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের পরিবর্তে “অত্যন্ত নির্দিষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন” প্রার্থী খুঁজছে।

নতুন প্রজন্মের হতাশা
২০২৫ সালের স্নাতকদের চাকরির আবেদন বেড়েছে, কিন্তু অফার কমেছে। বেলর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ২৩ বছর বয়সী কোবি বেকার বলেন, “চাকরির বাজারে ঢোকার মই যেন হঠাৎ সরিয়ে নেওয়া হলো।”
তিনি অবশেষে কাস্টমার সার্ভিসে চাকরি পেয়েছেন, তবে বলেন, অনেক তরুণ স্বাধীন হতে চাইলেও সুযোগ পাচ্ছে না।
এআইয়ের যুগে প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপান্তর
এক পরামর্শক সংস্থার প্রধান মাইক হফম্যান জানান, গত ছয় মাসে তিনি সফটওয়্যার ডেভেলপারদের ৮০ শতাংশ কমিয়েছেন, অথচ উৎপাদন বেড়েছে। “এখন আমাদের এআই নিজেই পাইথন কোড লেখে,” বলেন তিনি।
একইভাবে অনলাইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘চেগ’ সম্প্রতি ৩৮৮ কর্মী ছাঁটাই করেছে—মোট কর্মীর ৪৫ শতাংশ—কারণ প্রতিষ্ঠানটি এখন এআই-ভিত্তিক সিস্টেমে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের স্বয়ংক্রিয় উত্তর দেয়।
কর্পোরেট আমেরিকার এই পরিবর্তন এক গভীর বাস্তবতা তুলে ধরছে—যেখানে প্রযুক্তি, এআই, ও খরচ-সাশ্রয় নীতির চাপে সাদা কলার চাকরিগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, আর কর্মজীবনের নিরাপত্তা হয়ে উঠছে অতীতের বিষয়।
#যুক্তরাষ্ট্র #চাকরিচ্যুতি #আমাজন #এআই #অর্থনীতি #সাদা_কলার #বেকারত্ব #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















