আজ থেকে ৪১ বছর আগে এই দিনে ঢাকার ওয়াইজ ঘাটের বুলবুল ললিতকলা একাডেমির নিচ তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে – ইন্দিরা গান্ধীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ও অল ইন্ডিয়া মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে এ খবর পাই ।
রেডিওর পাশে আরও লোক জড়ো থাকায় বুঝতে পারি, আগেও এ সংবাদ বুলেটিন প্রচার করা হয়েছে। রেডিওটার ভলিউমটা বেশ বাড়ানোই ছিলো। কিন্তু সেদিকে আর আর এগুতে পারেনি। পা দুটো যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই থেমে যায়। মুহূর্তে চোখ দুটো কেমন যেন একটা আলাদা অন্ধ হয়ে যায়- সামনে পেছনে এত মানুষ থাকতেও কাউকে দেখতে পাইনি। কেবল চোখের সামনে ভেসে ওঠে শরণার্থী শিবিরে সাদা শাড়ি পরা সেই মাতৃ মুখটি। এর আগেও আমার বহু লেখায় স্মরণ করেছি, বাবার সঙ্গে মুষলধারার বৃষ্টির মাঝে ছাতার নিচে ভিজতে ভিজতে লবণহ্রদে (আজকের সল্ট লেক) কাদায় দাঁড়িয়ে দেখা তার মুখখানি।
আসলে কেন ওই মুখটা দেখতে পেলে মনটা অন্য রকম হতো তা ওই সময়ে বুঝতাম না। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শোনার পরেও অশ্রু ভরা চোখের সামনেও যখন তার মুখটি ভেসে ওঠে তখনও সঠিক বুঝতে পারেনি।
আজ বুঝতে পারি, কোন শিশুর অন্ধকারে চারপাশে যখন মনে হয় অসংখ্য ভূত ও পেত্নী- সেই ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসার মুহূর্তে মাকে দেখতে পেলে- শিশু যেমন ভরসা পায়- তার সব ভয় কেটে যায়- ১৯৭১ সালের শরণার্থী শিবিরে ওই মুখখানি ছিলো আমাদের মত কিশোর বা তারুণ্যের দিকে পা বাড়ানো বুকগুলোর জন্য তেমনি।
এই আবেগের বাইরে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে অনেক লেখার আছে। অনেকেই লিখেছেন। তাঁর দেশীয় গণ্ডিতে তাঁর রাজনীতি, একনায়কতন্ত্র, তাঁর রাজনৈতিক মনোবল, তাঁর ব্যক্তিত্ব, মানবতা, আবার রাষ্ট্রনায়কসুলভ কঠোরতা, জওয়াহের লাল নেহরুর গণতন্ত্র আর তাঁর গণতন্ত্রের পার্থক্য। এমন কি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই কীভাবে অবচেতনভাবে তাকে অনুসরণ করে- এমনই বহু দিক।
কিন্তু আজ তাঁর মৃত্যুদিনে কেবলই মনে হয়, গণতন্ত্র, শিক্ষা ও বিশেষ করে পারিবারিক মূলবোধের ভেতর দিয়ে একটা মানুষ যে সফট পাওয়ারের অধিকারী হয়- সেই সফট পাওয়ার কতটা শক্তিশালী তা প্রমাণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে মতিলাল নেহরুর নাতনি, জওয়াহের লাল নেহরু কন্যা রবীন্দ্রনাথের ছাত্রী -রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত “প্রিয়দর্শনি” নামের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একসঙ্গে সব থেকে বড় সারেন্ডার ঘটিয়ে জয় করে দেন বাংলাদেশ নামক দেশটিকে।

এই বারো দিনের যুদ্ধে তাঁর গোলাবারুদ, অফিসার, সৈনিক হারাতে হয়েছিলো ছিলো। আর আকাশে বোমারু বিমান আর নিচে ট্যাঙ্কের ঘরঘর শব্দ- এ যুদ্ধটাই এখন গেঁথে আছে এ দেশের মানুষের মনে।
কিন্তু ওই যে পারিবারিক শিক্ষায় আবার রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা মনন ইন্দিরা গান্ধীর- তাই তিনি ধীরস্থিরভাবে যুদ্ধটা শেষ করতে ৯ মাস সময় নিয়েছিলেন।
এপ্রিলে মুজিবনগর সরকার যখন গঠিত হয় সে সময়ে পাকিস্তান তাদের প্রয়োজনীয় সৈন্য এখানে নিয়ে আসতে পারেনি। ভারতের আকাশপথ, জলপথ বন্ধ করে দেওয়ায়- শ্রীলঙ্কা ঘুরে তাদের আসতে বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ওই অস্ত্রের দুর্বলতা আর সক্ষমতার হিসেব করেননি যুদ্ধে।
বরং ইয়াহিয়ার ভুল আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফলতা যে তিনটি সফট পাওয়ার তার হাতে তুলে দিয়েছিলো সেটাকে তিনি পরিপূর্ণ ব্যবহার করে- তার ভেতর দিয়ে জয় অর্জিত হয়ে যাবার পরেই তিনি গোলা বারুদ নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। “বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি জয় করে বাংলাদেশকে দিয়ে দেবার জন্যে” ।
শেষের বাক্যটি আমার নিজের, তারপরে ইনভার্টেড কমার ভেতর রেখে আলাদা করলাম এ কারণে যে- এর ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে। তাই এটা আলাদা করে একটু ব্যাখ্যা করার জন্যে। কারণ ৩ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তান পশ্চিমখণ্ডে ভারত আক্রমণ করলে- ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যে কারণে আজও যুদ্ধের ইতিহাসে- যুদ্ধটা ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধ।
ভারত যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তার আগেই কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী এ যুদ্ধে জয়লাভ করে বসে আছেন। তাই তিনি জানতেন, আইনত জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পাকিস্তানকে ভারতের কাছে সারেন্ডার করতে হবে। আর যখনই ভারতের কাছে পাকিস্তান সারেন্ডার করবে তখনই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান ভারতের অংশ।
কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী যে যুদ্ধে জয়লাভ করার পরে এই সমাপ্তি টানতে নেমেছেন সেখানে তো তিনি বাংলাদেশের ধাত্রীর ভূমিকা নিয়েছেন। তাই সে কাজটিও তিনি করেন আইনত। তিনি ৪ তারিখ তার ইস্টার্ন কমান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে মিলিত করে যৌথ বাহিনীর স্বীকৃতি দিয়েই পূর্ব খণ্ডে যুদ্ধে নামেন। ৫ তারিখে তার অনুরোধে ভুটান স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। আর ৬ ডিসেম্বর তাঁর দেশের পার্লামেন্টে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। যাতে পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের কাছে হেরে যাবার পরেও এ ভূখন্ড বাংলাদেশ হতে আইনত কোন বাধা না থাকে। এবং ভারতের এর ওপর কোন দাবি না থাকে। কারণ, ভারত আগেই তাদের পার্লামেন্টে এ দেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এবং তাদের পার্লামেন্টে সর্বদলীয়ভাবে সেই স্বীকৃতিকে অনুমোদন দিয়েছে।

কিন্তু এই স্বীকৃতি ও সরাসরি যুদ্ধে আসার আগে তিনি যে তিনটি বিষয় হাতে পেয়েছিলেন, তাহলো- এক, পাকিস্তানের পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পার্লামেন্টেও প্রায় সবগুলো আসন পাওয়ার পরেও তাদেরকে সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি। বরং তার বদলে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যা শুরু। দুই, পাকিস্তানের শাসক গণহত্যা চালানোর ফলে এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। তিন, পাকিস্তানের নির্বাচিত সংসদীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ( যিনি মূলত আইনত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা) তাকে গ্রেফতার করা ।
ইন্দিরা গান্ধী এই তিনটি ইস্যু নিয়ে নিজে, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা ( পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী), থিঙ্ক ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে শিল্পী , খেলোয়াড় সবাইকে সারা পৃথিবীতে পাঠান পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে। তিনি নিজে কতগুলো দেশে গিয়েছিলেন ও কী সেখানে বলেছিলেন তার একটা অংশ মেলে India speaks ( যদি স্মৃতি ভুল না করে তাহলে বইয়ের নাম এটাই) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বইটা বের হয়েছিলো।
অন্যদিকে যে এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়েছিলো তার প্রায় নব্বই ভাগই ছিলো হিন্দু। ভারত বা ভারতের কোন নেতা, সর্বোপরি ইন্দিরা গান্ধী কখনও বলেননি, হিন্দুরা শরণার্থী হয়েছে। পশ্চিমা সাংবাদিকরা হাজার চেষ্টা করেও ভারতের কাউকে দিয়ে এবং ইন্দিরা গান্ধীকে দিয়ে তো নয়ই- বলাতে পারেনি যে “হিন্দু শরণার্থী” । বরং তিনি গোটা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন, তাঁর দরিদ্র দেশকে এক কোটি পাকিস্তানি শরণার্থীর আশ্রয়, খাওয়া ও চিকিৎসা সহ সব কিছুর ভার নিতে হয়েছে।
এবং এই জনমত গড়ার ক্ষেত্রে তিনি কখনই কোন বাধা পেয়ে থেমে যাননি। রাষ্ট্রকে পাশে না পেলে রাষ্ট্রের জনগণের কাছে গেছেন। যেমন আমেরিকায় গিয়ে নিক্সনের সঙ্গে তার বৈঠক ব্যর্থ হলেও তিনি বিন্দু মাত্র দমে যাননি। বরং অতি স্বাভাবিক মুখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের সামনে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা ও পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরকার গঠন করতে না দেওয়ার কথা বলেছেন। এবং আমেরিকাতে শেষ পর্যন্ত তিনি তার এই জনমত গড়ে তোলার সফট পাওয়ার দিয়েই জয়ী হন। সিনেটে ও কংগ্রেসে বেশি সংখ্যক সদস্য পাকিস্তানকে অস্ত্র দেবার বিষয়টি ঠেকিয়ে দেয় বার বার।

আর সেখানকার সাধারণ মানুষ সাহায্য পাঠায় শরণার্থীদের জন্যে, সিনেটর কেনেডি এক ঝাঁক সাংবাদিক নিয়ে আসনে শরণার্থী শিবিরে। আমেরিকার জনমত আরও চলে আসে পাকিস্তানের গণহত্যার বিপক্ষে।
অন্যদিকে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলেও তাঁর পার্লামেন্ট তাঁকে নিয়ে কথা বলার জন্যে অপেক্ষা করেছেন আগস্ট মাস অবধি। আগস্ট মাসে যখন ক্যাঙ্গারু কোর্টে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু করে ইয়াহিয়া তার পরে। আর যখন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড নির্ধারিত করে ওই ক্যাঙ্গারু কোর্ট তখনই ইন্দিরা গান্ধী নিজে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানকে টেলিফোন করে, চিঠি দিয়ে, একের পর এক বিদেশ সফর করে বিশ্বজনমত গড়ে তোলেন প্রহসনের ওই বিচারের বিরুদ্ধে।
আর তখনই তিনি দেখিয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও রাষ্ট্রনায়কোচিত যোগাযোগের এবং গণতান্ত্রিক ভারতের ক্ষমতা। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সময়জ্ঞান, ধৈর্য আর ভাষা প্রয়োগ একজন নেতা নিজেকে কোন উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে।
তাই নভেম্বরের শুধু বঙ্গবন্ধুর বিচারের রায় কার্যকর থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়নি ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান। বাস্তবে ইন্দিরা গান্ধী সৃষ্ট বিশ্ব জনমতের কাছে নভেম্বরেই পাকিস্তান হেরে যায়- ডিসেম্বরের যুদ্ধ তখন থাকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
জাতি হিসেবে বাঙালি তো বাঙালিই। রবীন্দ্রনাথই বলে গেছেন, “ রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি” ।
আর আমাদের বঙ্গমাতা আমাদের বাঙালি রেখে দিয়েছে মানুষ করেনি বলেই আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গুড়িয়ে দিয়ে বিরিয়ানি খাই। আর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পালনের সময় ঢাকার রাজপথে ইন্দিরা গান্ধীর ছবি দিয়ে একটি পোস্টারও লাগানো হয়না।

কিন্তু কালজয়ী শিল্পী হুসেন তো চিরকালের ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন তার একটি শিল্পকর্মে , ইন্দিরার মাতৃজনন পথ থেকে বের হয়ে আসছে আমাদের বাংলাদেশের ম্যাপ ও পতাকা।
আর আমাদের মত কোটি কোটি মানুষের স্মৃতিতে আছে বা অনেকে ওই স্মৃতি নিয়ে– এ পৃথিবী থেকে চলে গেছে- সাদা শাড়িতে সেই অসীম ধৈর্যের মুখখানা।
আর এই মুখটি বেশি মনে পড়ে যখন পৃথিবীর যে কোন দেশে শুধু নয়, ইন্দিরা গান্ধী, তোমার দেশের রাজধানীতে গিয়েও বলতে পারি- আমি বাংলাদেশের নাগরিক। আর তখনও মনে পড়ে ইন্দিরা গান্ধীর সেই চিরকালের মাতার মত অসীম ধৈর্যের মুখটি। যে মুখ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গীতার “নিষ্কাম ধর্মের” ব্যাখ্যা করেছেন। যে প্রকৃত নিষ্কাম বা নিঃস্বার্থ কাজ বুঝতে হলে আমাদের ঘরে ঘরে যে মায়েরা আছে তাদের মুখ ভালো করে দেখতে হবে।
ইন্দিরা গান্ধী রাজনীতিবিদ, তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকবে- আবেগ থাকবে না সেখানে এক বিন্দু। কিন্তু বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে মিলিয়ে শরণার্থী শিবির দেখা, মুক্তিযুদ্ধের রক্ত –সাগর দেখা একজন মানুষ হিসেবে তাঁর নির্মম মৃত্যুর দিবসে তাঁর মাতৃসম মুখটিই মনে আসবে- বাংলাদেশের যে কোন কৃতজ্ঞ মানুষের মনে।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.
স্বদেশ রায় 























