যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বিনিয়োগের নতুন অধ্যায়
মিসিসিপি নদীর তীরে অবস্থিত আর্কানসাসের ছোট শহর ওসসিওলা একসময় কাঠ ও শস্যবাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। আজ তা তার পুরনো জৌলুস হারালেও নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগে। এই উন্নয়নের পেছনে আছেন একদল চীনা বিনিয়োগকারী, যারা যুক্তরাষ্ট্রের EB-5 অভিবাসন-বিনিয়োগ কর্মসূচির মাধ্যমে বসবাসের অনুমতি ও নাগরিকত্বের পথে অগ্রসর হচ্ছেন।
EB-5 ভিসা প্রোগ্রাম বিদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের বিনিময়ে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দেয়। এই কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবছর হাজারো মানুষ মার্কিন মাটিতে পা রাখেন—এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ চীনের নাগরিক। নিউজউইকের অনুসন্ধান বলছে, ওসসিওলার শিল্পপ্রকল্পগুলোতে শতাধিক চীনা বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন—যাদের অনেকেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
নিরাপত্তা ও প্রভাবের প্রশ্ন
যদিও কোনো অবৈধ লেনদেনের প্রমাণ মেলেনি, তবু যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের প্রভাবশালী নাগরিকরা যদি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিনিয়োগ করেন, তবে তা ভবিষ্যতে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।
এক মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “এমন বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে—এটি উপেক্ষা করা যায় না।”

সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা
এফবিআই আশঙ্কা করছে, চীন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে মিসিসিপি নদী অঞ্চলে শিল্প ও সম্পত্তি কিনছে। সংস্থাটি মনে করছে, এর লক্ষ্য হলো সরবরাহ শৃঙ্খলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও গুপ্তচরবৃত্তির সুযোগ সৃষ্টি করা।
চীনা কোম্পানিগুলোর এসব উদ্যোগ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে চীনবিরোধী নীতির সঙ্গে জড়িত বড় বিতর্কে পরিণত হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন যেখানে একদিকে চীনা ছাত্রদের ভিসা বাতিল করছে, সেখানে আবার ধনী বিদেশিদের “গোল্ড কার্ড” কর্মসূচির আওতায় নাগরিকত্ব দিচ্ছে।
EB-5 ভিসা: ধনীদের জন্য নাগরিকত্বের টিকিট
EB-5 কর্মসূচি চালু হয় ১৯৯০ সালে। শুরু থেকেই এটি চীনা ধনীদের মধ্যে জনপ্রিয়। ২০২২ সালে মার্কিন কংগ্রেস নতুন করে কর্মসূচিটি সংস্কার করে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রিন কার্ড পেতে ন্যূনতম বিনিয়োগের পরিমাণ ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ মার্কিন ডলার।
২০২৪ অর্থবছরে ১৪,৯২৪ টি EB-5 ভিসা প্রদান করা হয়—এর মধ্যে ৬৪ শতাংশই চীনের নাগরিকদের হাতে যায়। ভারত ও ভিয়েতনামের বিনিয়োগকারীরা পেয়েছেন প্রায় ১০ শতাংশ করে।

চীনা কোম্পানির ভূমিকা ও পার্টি-সংযোগ
এই বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোতে চীনা কোম্পানির সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। সাংহাইয়ের ‘হুইচিয়াও ইমিগ্রেশন গ্রুপ’ (‘Wise Visa’) নিজেদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে যে তারা চীনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুমোদিত সংস্থা এবং তাদের “এই উন্নয়ন, সরকারের বহু নেতার সহায়তায়, সম্ভব হয়েছে।”
আরেকটি প্রতিষ্ঠান, শেনজেনভিত্তিক ‘চিয়াওলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল’, চীনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ অভিবাসন সমিতির সদস্য। প্রতিষ্ঠানটি বিলাসবহুল হোটেলে আয়োজিত সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের সুযোগ তুলে ধরছে।
এই কোম্পানিগুলো চীনের উচ্চবিত্তদের বোঝাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ মানেই “স্বাধীনতার দেশে বসবাসের সুযোগ।”
ঝুঁকিপূর্ণ স্বাধীনতা: পর্যবেক্ষণের ছায়া
চীন থেকে যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের ভ্রমণ ও অর্থ স্থানান্তর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসাপেক্ষ। মানবাধিকার সংস্থা ‘সেইফগার্ড ডিফেন্ডার্স’-এর লরা হার্থ বলেন, “চীনে ধনী কেউ স্বাধীনভাবে ভ্রমণ বা বিনিয়োগ করতে পারেন না, যদি না পার্টির অনুমোদন থাকে। এতে করে আশঙ্কা থাকে যে চীনা সরকার এই সুযোগকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “বিদেশে অবস্থানরত চীনা নাগরিকদেরও আইন অনুযায়ী নিরাপত্তা সংস্থাকে সহযোগিতা করতে হয়—এটিই একটি বড় ঝুঁকি।”

ওসসিওলায় বিনিয়োগ, কিন্তু নেই বসবাস
যদিও বিপুল অর্থ আসছে চীন থেকে, স্থানীয় পর্যায়ে চীনা উপস্থিতি খুবই সীমিত। ওসসিওলায় দুটি রেস্টুরেন্ট ছাড়া চীনা সম্প্রদায়ের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। বিনিয়োগকারীরা গ্রিন কার্ড পেলেও সেখানে বসবাস না করে যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোয় চলে যাচ্ছেন।
ACC ক্যাপিটালের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাশ ডিকন বলেন, “আমরা আমাদের প্রকল্পগুলো নিয়ে গর্বিত। এই বিনিয়োগ বিলিয়ন ডলার এনে দিয়েছে এবং স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।”
নতুন শিল্পায়ন ও সম্ভাবনার দিগন্ত
ওসসিওলার মেয়র জো হ্যারিস জুনিয়র বলেন, “স্টিল মিলগুলো শহরের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। ভালো বেতনের চাকরি এসেছে, জীবনমান উন্নত হয়েছে।” বর্তমানে শহরের দারিদ্র্যের হার ২৭ শতাংশ হলেও, শিল্পায়ন এই চিত্র বদলাচ্ছে।
ওসসিওলা এখন রেল, নদী ও সড়কপথে সংযুক্ত একটি কেন্দ্রবিন্দু, যা নিউ অরলিন্স থেকে শিকাগো পর্যন্ত শিল্প যোগাযোগ সহজ করেছে।

EB-5 বিনিয়োগের আর্থিক প্রভাব
ACC ক্যাপিটালের ‘পাইন স্টেট রিজিওনাল সেন্টার’ নামে সংস্থা এই EB-5 তহবিল পরিচালনা করে। তাদের সাংহাই অফিসে চীনা নাগরিকরাই পরিচালনাকারী। এখন পর্যন্ত পাঁচটি বড় প্রকল্পে (তিনটি স্টিল মিল, একটি সোলার প্ল্যান্ট, ও একটি পরিবহন টার্মিনাল) বিনিয়োগ হয়েছে।
প্রথম দুটি প্রকল্পে ২৪০টি EB-5 ভিসার মাধ্যমে ১২ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়। হাইবার স্টিল প্রকল্পে যুক্ত হয় ৪৮৭টি ভিসা, যার মূল্য প্রায় ৩৯ কোটি ডলার।
সমালোচনা ও সতর্কতা
মার্কিন কংগ্রেসের সরকারি হিসাব দপ্তর এক প্রতিবেদনে জানায়, EB-5 কর্মসূচিতে জালিয়াতি ও নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ২০২২ সালের সংস্কারে স্বচ্ছতা ও গ্রামীণ এলাকায় বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
মার্কিন নাগরিকত্ব ও অভিবাসন বিভাগ জানিয়েছে, প্রতিটি বিনিয়োগকারীর নিরাপত্তা যাচাই কঠোরভাবে করা হয়। সংস্থার মুখপাত্র ম্যাথিউ ট্র্যাগেসার বলেন, “আমরা প্রতিটি আবেদনকারীকে সম্পূর্ণভাবে যাচাই করি, যাতে মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে।”
ওসসিওলার মতো দরিদ্র অঞ্চলে চীনা পুঁজির প্রবাহ স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করেছে, কিন্তু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিনিয়োগের পেছনে রয়েছে ভিন্ন এক রাজনৈতিক প্রভাবের কৌশল। একদিকে উন্নয়নের সম্ভাবনা, অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক শঙ্কা—এই দ্বন্দ্বই এখন নতুন আমেরিকান স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু।



#চীন_মার্কিন_সম্পর্ক, #অভিবাসন_নীতি, EB5_ভিসা, #আর্কানসাস, #মার্কিন_নাগরিকত্ব, #অর্থনীতি, নিরাপত্তা, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















